বই-দলিলপত্র-প্রবন্ধসকল কনটেন্ট
Trending

যুবকশূন্য সেই গাঁয়ের কথা – আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ

বই পড়তে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি' এ্যাপটি ব্যবহার করুন।

যুবকশূন্য সেই গাঁয়ের কথা

আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ

প্রথম আলো

১১-১২-২০০৯

গ্রামটির নাম থানাপাড়া। দেশের আর দশটা গ্রামের মতো রাজশাহীর এই গ্রামটিও গাছগাছালি আর পাখির ডাকে একটা ছবির মতো দাঁড়িয়ে আছে। পাশ দিয়ে প্রবল উচ্ছ্বাসে বয়ে গেছে পদ্মা। পদ্মায় মাছ ধরে, জমিতে ধান চাষ করে, রাতে গানের আসর বসিয়ে দিব্যি কাটছিল গায়ের লোকজনের জীবন।

সেই জীবনটাই একদিন এলোমেলো হয়ে গেল। এক দিন ঠিক দুপুরবেলায় বুটের মচমচ আওয়াজ তুলে, মুখে অচেনা বুলি বলে এই গ্রামে ঢুকে পড়ল পাকিস্তানি সেনারা। কাতারে কাতারে মানুষ নিয়ে দাঁড় করানো হলো নদীর ধারে। সব লোক জড়ো হওয়ার পর আলাদা করে ফেলা হলো পুরুষ আর মহিলাদের।

তারপর এই দুনিয়ায় নাত্সী হত্যাকাণ্ডের চেয়েও জঘন্য আরেকটি হত্যাকাণ্ড ঘটানো হলো! একসঙ্গে মেরে ফেলা হলো গ্রামের তিন শতাধিক যুবককে! ইচ্ছেমতো লুট করা হলো বাড়িগুলো, নির্যাতন চলল বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর ওপর।

এর পরও কি এই গ্রামটির টিকে থাকার কথা? অন্য কোনো দেশ হলে কী হতো, কে জানে! কিন্তু এ গ্রামের বেঁচে যাওয়া মানুষেরা যে বাঙালি। এরা মরতে জানে না, লড়তে জানে। সেই লড়াইটাই শুরু করলেন ‘বিধবাদের গ্রামের’ বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো।

ইতিহাসের কী অপূর্ব খেলা! পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালে যে গ্রামটিকে যুবকশূন্য করে ফেলেছিল, সেই গ্রামটি এখন দুনিয়ার হাজারো মানুষের জন্য এক বিস্ময়ে পরিণত হয়েছে। দেশি-বিদেশি বন্ধুদের হাত ধরে সেই গ্রামটি এখন হস্তশিল্পের জন্য ইউরোপ-আমেরিকাজুড়ে খ্যাতি পেয়ে গেছে।

রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার সরদহ ইউনিয়নের গ্রামটির এই ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান এক সুইডিশ দম্পতির। ১৯৭২ সালের অক্টোবরে রয় জোহানসন ও অনিতা এন্ডারসন দম্পতি বেড়াতে আসেন গ্রামটিতে। এঁরা ছিলেন সুইডেনের সোয়ালোজ নামের একটি সংস্থার ভারতীয় শাখার কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গ্রামটির অবস্থা দেখার জন্য পাঠানো হয়েছিল তাঁদের। অবস্থা দেখে শিউরে উঠলেন রয় ও অনিতা। আশার আলোও খুঁজে পেলেন। গ্রামটির মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে চায়। সেই চাওয়া পূরণ করতে এখানে শুরু হলো ‘সোয়ালোজ আন্দোলন’।

সোয়ালোজ একটি পাখির নাম। সুইডেনে বসন্ত আগমনী বার্তা নিয়ে আসে এই পাখি। থানাপাড়া গ্রামেও দুর্যোগের পর বসন্ত নিয়ে আসবে সোয়ালোজ—এমন স্বপ্ন নিয়ে কাজ শুরু করলেন রয়-অনিতারা। সঙ্গে শত শত বিধবা নারী। ১৯৭৪ সালের গোড়ার দিকে এই গ্রামে শুরু হয় তাঁতের কাপড় দিয়ে পোশাক, পাট দিয়ে শিকা, কার্পেট ও মেট, নকশিকাঁথা ইত্যাদি তৈরি। কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল গ্রামের মানুষ। আর এই উত্পাদিত পণ্য বিশ্ববাজারে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করতে লাগল সোয়ালোজের লোকজন।

সোয়ালোজের এই বিদেশিরা এখানে থাকতে আসেনি। বাংলার লড়াইয়ে বাঙালিরাই জিততে পারে, বুঝতে পেরে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়া শুরু করে তারা। ১৯৯৭ সালে স্থানীয় লোকদের হাতেই সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে চলে যায় সুইডিশরা।
এখনো দারুণভাবে চলছে হস্তশিল্পের কাজ। এখন আর এই গ্রাম দেখে বোঝার উপায় নেই, এটি একদিন ধ্বংস হতে বসেছিল। এখানকার উত্পাদিত পণ্য এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এ প্রতিষ্ঠানে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের সন্তানদের রাখার জন্য একটি দিবাযত্ন কেন্দ্র রয়েছে।

এই কেন্দ্রে ৪৫ জন শিশু থাকে। বাচ্চাদের পড়াশোনার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে একটি স্কুল। আছেন পাঁচজন শিক্ষক। চারঘাটে সোয়ালোজ হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠানে এখন ২২০ জন নারী কাজ করেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন শহীদ পরিবারের প্রায় দেড় শ নারী। সরাসরি পাঁচ শহীদের স্ত্রীও রয়েছেন।

তাঁদের মধ্যে একজন হচ্ছেন ওয়াজান বেওয়া। তিনি এখন সোয়ালোজের তাঁতের সুতা তৈরির কাজ করেন। ওয়াজান বেওয়া এখনো দেখতে পান ১৯৭১-এর সেই দিনটা, ‘গ্রামে মিলিটারি ঢোকার কথা শুনে সবাই পদ্মা নদীর ধারে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম। বেলা আড়াই-তিনটার দিকে মিলিটারি ঘিরে ফেলল আমাদের। কেউ পালাতে পারল না। কিছুক্ষণ পর বাচ্চাদের নিয়ে মেয়েদের চলে যেতে বলা হলো। ভাবছিলাম, পেছন থেকে আমাদের গুলি করে মারবে। আমরা বেঁচে গেলাম ঠিকই। কিন্তু ওখান থেকে আমরা চলে আসার খানিক পরই সব পুরুষ মানুষকে মেরে ফেলল ওরা। স্বামীর লাশটাও দাফন করতে পারিনি।’

এমন গল্প এই গ্রামের অনেকের। এই স্মৃতির কষ্টটা আছে। সেই সঙ্গে আছে জীবন-যুদ্ধ জয়ের গর্বও। গর্ব এখন ওয়াজান বেওয়ারা করতেই পারেন। তাঁদের যুদ্ধজয় দেখতে এখন দেশ-বিদেশ থেকে লোক আসে।

ভারত, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন থেকে যুবকেরা আসে গ্রামটির উন্নয়নের গল্প শুনতে। এখানকার নারীদের সংগ্রামের কথা শুনতে। এই তো গত ৯ নভেম্বর থেকে উরুগুয়ে, চিলি, বুরুন্ডি, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া ফিনল্যান্ড ও ভারত ‘এমাউস ইন্টারন্যাশনালের’ ১৯ জন সদস্য এসেছিলেন।

তাঁরা সবাই মুগ্ধ গ্রামটির নারীদের সংগ্রামের গল্প শুনে। এই মুগ্ধ ব্যক্তিদের একজন ছিলেন ফিনল্যান্ডের মেয়ে ক্যারিনা। গ্রামটির গল্প শুনে বললেন, ‘১৯৭১ সালে এখানে একটি যুবকশূন্য গ্রাম তৈরি করতে চেয়েছিল কিছু লোক। অথচ আজ দেখুন, দুনিয়ার হাজারো যুবকের গ্রামে পরিণত হয়েছে জায়গাটি। এভাবেই তো আপনারা জিতলেন।’

হ্যাঁ, এ-ও আমাদের আরেক যুদ্ধ জয়!

মন্তব্যসমূহ
বই পড়তে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি' এ্যাপটি ব্যবহার করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button