মুক্তিযুদ্ধে কল্যাণপুর গণহত্যা
আনোয়ার কামাল
২৮ এপ্রিল ২০১৯
আজ কল্যাণপুর গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের দোসররা রাজধানীর কল্যাণপুরে শত শত মানুষকে পশুর মতো জবাই করে হত্যা করেছিল। ইতিহাসে এ ঘটনার তেমন উল্লেখ না থাকলেও কল্যাণপুরবাসী তাদের হৃদয়ের গভীরে জিইয়ে রেখেছেন। যেসব পরিবার এ হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছিলেন, তাদের সবাই এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন না। অনেকেই চাকরির সুবাদে ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করতেন।
তাছাড়া হত্যাযজ্ঞের দিন অনেককে ধাওয়া করে এখানে নিয়ে এসে হত্যা করা হয়েছিল। এ কারণে স্বজন হারানো অনেকেই জানতে পারেননি তাদের পরমাত্মীয়রা সেদিন এখানে চরম নির্মমতার শিকার হয়েছিল। পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রায় প্রতি রাতেই বিহারি ও তাদের বাঙালি দালালদের সহায়তায় বিভিন্ন জায়গা থেকে মুক্তিকামী বাঙালিদের ধরে এনে কল্যাণপুর ব্রিজের ওপর থেকে গুলি করে নিচে পানিতে ফেলে দিত। তখন ব্রিজের নিচের খালটি সবসময় পানিতে ভরে থাকত। সে সময় বুড়িগঙ্গা নদীর সঙ্গে খালটির সংযোগ ছিল। লাশগুলো খালের পানিতে ভাসতে ভাসতে একসময় বুড়িগঙ্গা নদীতে চলে যেত।
২৮ এপ্রিল ভোর থেকেই মিরপুর ও মোহাম্মদপুর থেকে আগত বিহারিরা এবং তাদের এদেশের কিছু দোসর কল্যাণপুরে এসে বাঙালি নিধন ছাড়াও তাদের ঘরবাড়ি লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, হত্যা ও নারী নির্যাতন শুরু করে। এ গণহত্যাকে ‘কল্যাণপুর গণহত্যা’ বলা হলেও এর বিস্তার ছিল পাইকপাড়া, পীরেরবাগ, আহম্মদনগর, শ্যামলী, টেকনিক্যাল, গাবতলী থেকে গৈদ্দারটেক পর্যন্ত। বিহারিরা একদিকে মিরপুর থেকে বাঙালি নিধন করতে করতে পাইকপাড়া-পীরেরবাগ হয়ে কল্যাণপুরে চলে আসে, অপরদিকে মোহাম্মদপুরের আসাদগেট থেকে অন্য একটি গ্রুপ হত্যাযজ্ঞ চালাতে চালাতে কল্যাণপুরে ঢুকে পড়ে। তারা রড, লাঠি, সড়কি, তলোয়ার, কুড়াল, বল্লম, চাপাতি ও বন্দুক হাতে ধেয়ে আসে। বাড়িতে বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে নারী-পুরুষ-শিশুদের জবাই করে হত্যা করে।
২৮ এপ্রিল বিহারিরা কল্যাণপুরে ঢুকে প্রথমেই খোঁজ করতে থাকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের। বিশেষ করে তারা আওয়ামী লীগ নেতা ডা. হায়দার আলীকে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। কিন্তু সেদিন তিনি রাস্তার ম্যানহোলের মধ্যে আত্মগোপন করে নিজের জীবন রক্ষা করতে পেরেছিলেন। তিনি হত্যাযজ্ঞে নিহত আহসান উল্লাহ চৌধুরীর লাশসহ আহতদের নেয়ার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পরদিন সকালে আবার কল্যাণপুরে ফিরে আসেন। সেদিন প্রায় শতাধিক পুরুষ মানুষ দৌড়ে কল্যাণপুর জামে মসজিদের মধ্যে ঢুকে আত্মগোপন করে প্রাণে বেঁচেছিলেন। ২৮ এপ্রিল যাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তৎকালীন ডেইলি পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার প্রেস ম্যানেজার আহসান উল্লাহ চৌধুরী, মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী (মূক ও বধির), আবুবকর, সাইফুদ্দিন খান বাবু, তালেব আলী, ডা. মোহাম্মদ হাসেম, এসিআই কোম্পানির কর্মকর্তা সিরাজুল হক চৌধুরী, জুট বোর্ডের এসিসটেন্ট ডাইরেক্টর এআইএ আলাউদ্দিন, ইউনাইটেড ব্যাংক কর্মকর্তা এজেড এম জাকির উদ্দিন প্রমুখ।
কল্যাণপুর গণহত্যায় প্রথম উদ্ধারকারী হিসেবে যার নাম না বললেই নয়, তিনি হলেন বিশিষ্ট দানবীর টাঙ্গাইলের রণদা প্রসাদ সাহা। তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে টাঙ্গাইল থেকে ২৮ এপ্রিল বিকালে রেডক্রসের একটি অ্যাম্বুলেন্সসহ কল্যাণপুরে এসে মারাত্মক আহতদের টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে তার প্রতিষ্ঠিত কুমুদিনী হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসা পাওয়া অনেকে প্রাণে বেঁচে গেলেও পাক হানাদারদের হাত থেকে তিনি ও তার পুত্র বাঁচতে পারেননি। ১৯৭১ সালের ৭ মে স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকসেনারা এ দানবীর ও তার বড় পুত্রকে বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। তারা আর ফিরে আসেননি। কল্যাণপুরবাসী আজও তাকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে।
আনোয়ার কামাল : কবি ও সংস্কৃতিকর্মী