বই-দলিলপত্র-প্রবন্ধসকল কনটেন্ট
Trending

আজ থেকে তিনি আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব – তোফায়েল আহমেদ

বই পড়তে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি' এ্যাপটি ব্যবহার করুন।

প্রতীকী ছবি

“আজ থেকে তিনি আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব”

ঊনসত্তরের গণ আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু – তোফায়েল আহমেদ (পৃষ্ঠা ৩১-৩৩)

১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। সেদিনের রেসকোর্স ময়দান যারা দেখেননি তাদের বলে বােঝানাে যাবে না সেই জনসমাবেশের কথা। আমরা যখন সেখানে পৌছেছি তখন রেসকোর্স ময়দান ভরে গেছে। মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে অন্যদিকে রমনা পার্কে আশ্রয় নিয়েছে। ট্রেন বাস ট্রাক বােঝাই হয়ে ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, সিলেট, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম থেকে লঞ্চে স্টিমারে বরিশাল, খুলনা, যশােহর থেকেও নেতা কর্মী শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ ছুটে এসেছে। ঢাকার মানুষ তাে আছেই

অভিভূত হয়ে পড়লাম আমি!

এত মানুষ তাে একসাথে কোনােদিন দেখিনি। আমার বন্ধুরাও স্তম্ভিত। কিন্তু কত সুশৃংখল তারা। এরাই তাে আমাদের শক্তি। অনেকেই পত্রপত্রিকায় আমাদের নাম শুনেছেন, দেখেননি। তাদের সামনে আজ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দাঁড়াবে। আমরা মঞ্চে এসেছিলাম সবাই।

আমার আজো যখন মনে হয় সেদিনের সেই গণসবংর্ধনার কথা, কি এক শিহরণে আমার চোখ ফেটে পানি এসে যায়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা আবদুর রউফ, খালেদ মােহাম্মদ আলী, শামসুদ্দোহা, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, জামাল হায়দর, মাহবুবউল্লাহ, ফকরুল ইসলাম মুন্সি, ইব্রাহিম খলিল, নাজিম কামরান চৌধুরী কার কথা না আজো আমার মনে পড়ে!

মনে পড়ে জেলে বন্দী শেখ মনি ভাইয়ের কথা। বস্তুত ষাটের দশকে আইউবশাহীর সূচনা থেকে তিনিই বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনগুলাের ঐক্যের চিন্তার জন্ম দিয়েছেন। নিজেও প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তার বিভিন্ন পরামর্শ আসতাে জেল থেকে। জেলে বন্দী ছিলেন আমাদের রাজ্জাক ভাইও। তাঁর সাথেও যােগাযােগ ছিল। জেলের বাইরে ছিলেন সিরাজ ভাই, অর্থাৎ সিরাজুল আলম খান। তিনি যথেষ্ট সহায়তা করেছেন আমাকে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে। কোথাও কোনাে জটিলতা কিংবা বিবৃতিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন।

বলছিলাম ২৩ ফেব্রুয়ারি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়ার দিন। একটা ছাত্রের জীবনে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে? বাংলার অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠ নেতা শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিব যে মঞ্চে, যার সামনে দশ লক্ষেরও অধিক মানুষ, আমি সেই সভার সভাপতি। সেদিন ঐ মঞ্চে বক্তব্য রেখেছিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খালেদ মােহাম্মদ আলী, মতিয়া ছাত্র ইউনিয়নের সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক, মেনন ছাত্র ইউনিয়নের মাহবুবউল্লাহ এবং এন. এস, এফ-এর মাহবুবুল হক দোলন। আগেই বলেছি আমি ছিলাম সভাপতি, নিয়ম অনুসারে সকল বক্তার শেষেই আমার বক্তৃতা দেবার কথা কিন্তু নেতা বক্তৃতা দেবার পর আমি বলবাে এবং আমার ভাষণ কথা কেউ শুনবেন এমন আশা করার ধৃষ্টতা আমি কেন আমার বন্ধু নেতারাও ভাবেননি। তাই শেখ মুজিবের ভাষণের আগে আমাকে দাঁড়াতে হলাে। যাকে গণসবংর্ধনা দিচ্ছি তিনি ভাষণ দেবেন সবার শেষে সেটাই সাব্যস্ত হয়েছিল। আমার জন্য অবশ্য ভাষণ দেয়াটা তেমন জরুরী ছিল না, এরচেয়ে অনেক বড় একটা দায়িত্ব আমার উপর অর্পণ করা হয়েছিল সেটা হলাে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে জাতির অনুমােদন নিয়ে আমাদের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানকে একটি উপাধি দেয়া তার নামের সাথে অবিনশ্বর হয়ে থাকবে। তখন আর অস্বীকার করার কোনাে সুযােগ ছিল না—সবাই যা সত্য হিসেবে চোখের সামনে লক্ষ্য করেছে তাহলাে সমগ্র জাতি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ।

গণসংবর্ধনায় এই অভিধা প্রদান নিয়ে আমরা ছাত্র নেতৃবৃন্দ আলােচনায় বসেছিলাম। আমরা একমত ছিলাম যে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে যে জাতীয় ঐক্যের সৃষ্টি হয়েছে, সমগ্র জাতি আমাদের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা স্থাপন করেছে সুতরাং যে মানুষটি শুধুমাত্র পূর্ব বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা স্বাধিকারের জন্য তাঁর জীবনের মূল্যবান গুরুত্বপূর্ণ সময়। জেলে কাটিয়েছেন অকুতােভয়, যার প্রতিটি উচ্চারণ আপােসহীন, যার লক্ষ্য। সুস্থির অটল, যিনি মৃত্যুর মুখােমুখি জাতি যাকে বুকে তুলে নিয়েছে, যাকে নেতা হিসেবে বরণ করেছে, যার জন্য রক্ত দিয়েছে তাঁকে গণউপাধিতে ভূষিত করার অধিকার অবশ্যই আমাদের আছে এবং ঐতিহাসিক কারণে এটা আমাদের কর্তব্যও যখন আমাদের সামনে সেই সুবর্ণ সুযােগ এসেছে। আমরা আলােচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে আমাদেরই এক ছােট ভাই নেতা শেখ মুজিবকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিলেন যার নাম ছিল ‘বঙ্গবন্ধু’। কবিতায় নেতাকে সে বঙ্গবন্ধু সম্বােধন করেছিল লাইনে লাইনে। আমরা তাে এর আগে বাংলার নয়নমণি, বঙ্গশার্দুল, অবিসংবাদিত নেতা, বাঙালির মুক্তিদাতা প্রভৃতি বিশ্লেষণে সম্বােধন করতাম কিন্তু বঙ্গবন্ধু অভিধাটি আমাদের সকলের কাছেই বেশ ভাল লাগলাে। সকলেই আমরা একমত হলাম। কেন যেন আমার খুব ভাল লাগলাে বঙ্গবন্ধু সম্বােধন। অবরুদ্ধ বাঙালি যেন হাজার হাজার বছর ধরে অপেক্ষায় ছিলেন এমন একজন বন্ধুর জন্য। চোখের সামনে বন্ধুর অবয়ব ভেসে ওঠে। বন্ধু অর্থ কি? বিশাল হয়ে সেদিন বন্ধুর ভাবার্থ আমার সামনে স্পষ্টতর ছিল। যিনি ভালবাসেন। শুধু ভালবাসেননা ভালবাসার জন্য আপােসহীন আমৃত্যু সংগ্রাম করেন। যার ভালবাসা নির্লোভ, নিঃস্বার্থ। শেখ মুজিব যখন বন্ধু তখন তিনি হয়ে ওঠেন বাংলার প্রকৃতির বন্ধু, বাংলার ভাষা কৃষ্টি সংস্কৃতির বন্ধু, বাঙালির জাতীয়তাবােধের বন্ধু, মুক্তিসংগ্রামের বন্ধু। সুতরাং একমাত্র শেখ মুজিবই হতে পারেন বঙ্গবন্ধু’! চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা কাউকেই আর বলিনি যে তাঁকে আজ সম্বােধনে ভূষিত করবাে।

সভাপতির ভাষণ দিতে আমি দাঁড়ালাম। জনগণের কাছে প্রশ্ন রাখলাম, যে নেতা তার যৌবন কাটিয়েছেন কারাগার থেকে কারাগারে, মৃত্যুভয় যার কাছে ছিল তুচ্ছ, প্রধানমন্ত্রিত্বও ছিল যার কাছে তুচ্ছ, যে নেতা বলেছেন আমি ক্ষুদিরামের বাংলার মুজিব, সূর্যসেনের বাংলার মুজিব, যিনি বলেছিলেন বাংলার মানুষের জন্য আমি হাসিমুখে জীবন দিতে পারি সেই নেতাকে আমরা একটি উপাধি দিয়ে বরণ করতে চাই। দশ লক্ষ জনতা হাত তুলে বলেছিল আমাদের পক্ষ থেকে তাঁকে উপাধি দিতে পারাে।

সেই সময়ই আমি ঘােষণা করলাম বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান, হাজার বছরের মহাপুরুষ নিপীড়িত লাঞ্ছিত প্রবঞ্চিত বাঙালির নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করলাম। আজ থেকে তিনি আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।

লক্ষ লক্ষ কণ্ঠে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হলাে জয় বঙ্গবন্ধু।

মন্তব্যসমূহ
বই পড়তে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি' এ্যাপটি ব্যবহার করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button