৭১’এর জেনোসাইড ও নির্যাতন আর্কাইভবই-দলিলপত্র-প্রবন্ধসকল কনটেন্ট
Trending

‘একাত্তরে আমরা ভুল করিনি’ – গোলাম আজম

বই পড়তে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি' এ্যাপটি ব্যবহার করুন।

‘একাত্তরে আমরা ভুল করিনি’ – গোলাম আজম ও জামাতের রাজনীতি

শাহাদত চৌধুরী সম্পাদিত সাপ্তাহিক বিচিত্রা

১৯৮১ সালের ১৭ এপ্রিল প্রকাশিত

লিখেছেন:

মাহফুজ উল্লাহ, আহমেদ নূরে আলম, শেহাব আহমেদ, মতিউর রহমান চৌধুরী

সহায়তা করেছেন:

কাজী জাওয়াদ, মাহমুদ শফিক, হাসান হাফিজ

[ শেয়ার করেছেন: বঙ্গদর্পন ]

 

সেই কালো শক্তি জামাতে ইসলামী এখন সর্বশক্তি নিয়ে সক্রিয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে। সক্রিয় ধর্মের নামে। ধর্মের নামেই ৭১ সালে জন্মলগ্নে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন করতে সর্বাত্মক অপপ্রয়াস চালিয়েছিল জামাত। সেই জামাত ৮১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে রক্ষা করবে ঘোষণা করেছে। তাদের এই ঘোষণা এসেছে স্বাধীনতা অর্জনকারী মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলার মধ্য দিয়ে।

বাংলাদেশে জামাতের সকল কার্যকলাপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জামাত কর্তৃক নির্বাচিত কিন্তু অঘোষিত আমীর এবং পাকিস্তানী নাগরিক অধ্যাপক গোলাম আজম। ৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের সশস্ত্র বিরোধিতার অভিযোগে ‘নাগরিকত্বহীন’ অধ্যাপক গোলাম আজম-এর নাগরিকত্ব পুনর্বহালের দাবীতে জামাত সংগঠিত হচ্ছে। অধ্যাপক গোলাম আজমের নেতৃত্বে জামাতীরা তাদের তথাকথিত ধর্মীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠায় রক্তাক্ত পথ অনুসরণের পক্ষপাতী। তারা শ্লোগান দিচ্ছে মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজী ইত্যাদি। কাফনের সাদা কাপড় পরে তারা বহু স্থানে মিছিল বের করেছে। কিন্তু এই জামাতী নেতা শুধু ৭১ সালে নয়, ৭৩ সালেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছেন। ৭৩ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে চাইলে অধ্যাপক গোলাম আজমই ছিলেন অন্যতম রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা। এমনকি বহু মুসলিম রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করে ‘একঘরে’ করে রাখার অপচেষ্টা করেছিলেন তিনি। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, মুসলিম রাষ্ট্রগুলো যাতে স্বীকৃতি না দেয় সেজন্যে উল্কার মতো তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। তার ও তার দলের সকল অপচেষ্টাকে ব্যর্থ করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ আজো অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। যে দেশের স্বাধীনতা চাননি, সশস্ত্র বাধা দিয়েই ক্ষান্ত হননি যিনি, স্বাধীনতার পর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী এই ব্যক্তিটি এখন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভের জন্যে কেনো মরিয়া হয়ে উঠেছেন? এই প্রশ্ন এখন সকলের মনে। বাংলাদেশকে তিনি চান কি না, বাংলাদেশের অস্তিত্ব বা আদর্শে বিশ্বাস করেন কি না সে প্রমাণ এখনো পাওয়া যায় নি। এব্যাপারে তিনি যা বলেছেন তাতে দৃঢ়ভাবে মনে করা যায় বাংলাদেশকে তিনি ‘রাষ্ট্র’ হিসেবে এখনো গ্রহণ করেন নি। তার দৃষ্টিতে বাংলাদেশ ‘একটা জমি, একটা মাটি, আর কিছু নয়। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের আদর্শ কি সে ধারণা আমার নেই। শুধু জানি, বাংলাদেশ একটা জমি, একটা মাটি, মাটির কোনো আদর্শ থাকে না। এই ভূখন্ডের অধিবাসীরাই ঠিক করবে কোন আদর্শের ভিত্তিতে দেশ চলবে।’ তার এ-কথা ৭১ সালের ৩১ আগস্টেরই কথার প্রতিধ্বনি। তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘কোনো ভালো মুসলমান তথাকথিত বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থক হতে পারে না।’ গোটা জাতি যেখানে স্বাধীনতার পক্ষে ছিলো সেখানে তিনি কেনো স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন? এ-প্রশ্নের উত্তর এখনো তিনি দেন নি। তবে জামাত দেশে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, যা অরাজকতা বিশৃঙ্খলতার দিকে দেশকে ঠেলে দেবে বলে বিভিন্ন মহলের রাজনীতিকরা আতংকিত। ইসলামী ভাবাপন্ন দলগুলোও জামাতের ক্রিয়াকলাপে আশংকিত। জামাত দেশে আবার ‘রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়ার নীল নকসা’ তৈরি করছে বলে কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন। জামাতীরা কেবল নিজেদেরকেই ‘মোমিন’ মনে করে, তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আর সবাই ‘কাফের’, হোক সে মুসলমান বা অন্য যে কোনো ধর্মের।

এই দেশের ধর্মপ্রাণ-ধর্মভীরু মুসলমানরা আর যাই হোক জামাতের দৃষ্টিতে মোমিন নয়। জামাতী হলেই তারা প্রকৃত মুসলিম হন। ধর্মকে সামনে রেখে জামাত এক সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে চায়, সাম্প্রতিককালের বিভিন্ন ঘটনাগুলো থেকে সকলের এ-ধারণা হয়েছে।

অতীত ও বর্তমান

১৯৪১ থেকে ১৯৮১। ৪০ বছর। ইতিহাসের পালা বদলের পালায় জামাতে ইসলামী। পাঞ্জাবের মওলানা সৈয়দ আবুল আলা মওদুদী জন্ম দিলেন জামাতে ইসলামী হিন্দের। বৃটিশ ভারত বিভাগ হল ১৯৪৭। দু-দেশে দুটি শাখা গঠন করে মওলানা মওদুদী অস্তিত্ব বজায় রাখলেন দলের।

প্রথমে ধর্মীয় আন্দোলন তারপর রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন মওলানা ও তার সংগঠন। ইসলাম ধর্মকে তার নিজস্ব ধ্যান ধারণার ছাচে ফেলে অসংখ্য বই পুস্তিকার মাধ্যমে প্রচার করতে লাগলেন জামাত অর্থাৎ যূথবদ্ধ জীবন ও ইসলামের প্রাথমিক শাসন পদ্ধতির মাধ্যমে রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েমের দর্শন। বিরোধ বাধল। প্রথমে মওলানা আলেমদের সঙ্গে ইসলাম সম্পর্কে তার নিজের ব্যাখ্যা নিয়ে এরপর সংঘাত পাকিস্তান প্রশ্নে।

মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হবার পর মুসলিম লীগ পাকিস্তান আন্দোলন নিয়ে এগিয়ে চলেছে।

মওলানা মওদুদী বললেন, কেবলমাত্র জামাতে ইসলামীর নেতৃত্বেই কায়েম হতে পারে মুসলিম রাষ্ট্র। মুসলিম লীগের পাশ্চাত্য শিক্ষিত নেতাদের হাতে নয়।

১৯৪৭-এর ভারত বিভক্তির পর ১৯৫১ সালে মওলানা মওদুদী আবার বিতর্ক সূচনা করলেন কাদিয়ানী প্রসঙ্গ নিয়ে। তারা মুসলমান নয় এ ফতোয়া দেবার পর লাহোরে বেধে গেল রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য মওলানা মওদুদীর বিচার হলো। ফাসির দন্ডাজ্ঞা সত্ত্বেও ক্ষমা পেয়ে গেলেন। এই ক্ষমায় বহিঃশক্তির হাত ছিল বলে বিশ্বাস করা হয়।
পরবর্তী পর্যায়ে ধর্মীয় ব্যাখ্যা ও জামাতের রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে আরও বিতর্ক বিরোধ চলল জামায়াতে ওলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম এবং অন্যান্য আলেমদের সঙ্গে।
১৯৬১ সালে আবার মওলানা মওদুদী জেলখানা থেকে বেরিয়ে বিতর্কের সূচনা করলেন। জন্মশাসন পরিকল্পনা ও মুসলিম পারিবারিক আইনের বিরুদ্ধে সারা পাকিস্তানব্যাপী বিক্ষোভ ও জন্মশাসনের প্রচারণার সাইন বোর্ড ভাঙার মাধ্যমে।
১৯৭১ সালে মওলানা মওদুদী যে পাকিস্তানের বিরোধিতা করেছিলেন তা রক্ষার জন্য হাত মেলালেন পাকিস্তানী সামরিক জান্তার সঙ্গে।

জন্ম হল পূর্ব পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর আমীর (প্রধান) অধ্যাপক গোলাম আজমের নেতৃত্বে দলের সশস্ত্র শাখা আল-বদর সংগঠনের।

২২ নভেম্বর ১৯৭১। জেনারেল নিয়াজীর বাহিনীর পরাজয়ের লক্ষণ সুস্পষ্ট হয়ে যাবার মুহূর্তে মওলানা মওদুদী তলব করলেন গোলাম আজম ও পাকিস্তান জামাতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর (সহসভাপতি) মওলানা আবদুর রহীমকে।
এক বিমানে তারা দুজন লাহোর পৌঁছালেন। ২৩ নভেম্বর পাকিস্তান রক্ষার সংগ্রামে তাদের ভূমিকার জন্যে সংবর্ধনা দেয়া হল।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন একটি রাষ্ট্র সংযোজিত হল। ঘাতকের অস্ত্র উপেক্ষা করে রক্তের ভিত্তির উপর জন্মগ্রহণ করল বাংলাদেশ।

বেঁচে গেলেন অধ্যাপক গোলাম আজম ও মওলানা রহীম। ১৯৭২ সালে পাকিস্তান ছেড়ে হজ্জ করার জন্য জেদ্দা গমন করলেন গোলাম আজম। সেখান থেকে দুবাই, আবুধাবী, কুয়েত, বৈরুত ও লিবিয়া সফর শেষে এপ্রিল ১৯৭৩ তিনি লন্ডনে চলে যান।

১৯৭৩-এ পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভূট্টো পাকিস্তানের সব রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্নে মতামত আহ্বান করেন।

এ উপলক্ষে পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর মজলিশে সূরার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। শুধু দুজন সদস্য মওলানা আবদুর রহীম ও চৌধুরী রহমতে এলাহী বলেন স্বীকৃতি দেয়া যায়। বিরোধিতা করলেন অধ্যাপক গোলাম আজম ও অন্যান্য নেতারা।

মওলানা রহীম এরপর প্রত্যাবাসন ফ্লাইটে দেশে ফিরে আসেন।

জানা গেছে গোলাম আজমের উদ্যোগে ১৯৭২ সালে পাকিস্তানে যে ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার সপ্তাহ’ পালিত হয় মওলানা রহীম তার বিরোধিতা করেন। জামাতে ইসলামী স্বাধীন বাংলাদেশে ভিন্ন প্রেক্ষিতে পাকিস্তানী আমলের রাজনীতি বর্জন করে গড়ে তোলার প্রশ্নে বিরোধ ক্রমাগত দানা বাধতে থাকে। এ ছাড়াও তিনি জামাতে ইসলাম নামে সংগঠনকে পুনর্জাগরিত করতে চাইলেন না বিশেষতঃ কালো অতীতের কারণে। জামাতের গোড়া রাজনীতিও তিনি এবং দলের অধিকাংশ কর্মীই চাচ্ছিলেন না। তারা অতীতের বিশেষতঃ ১৯৭১ এ দলের ভূমিকা ভুল বলে বিশ্লেষণ করে মতামত প্রকাশ করতে থাকেন। ফলে দলের চরমপন্থী নেতাদের সঙ্গে তাদের বিরোধ চূড়ান্ত পর্যায়ে যেতে থাকে। শঙ্কিত গোলাম আজম দেশে আসার সিদ্ধান্ত নেন।

জামাতে ইসলামী পুনর্জাগরিত করার ব্যাপারে কর্মীদের অনিচ্ছা থাকলেও গোলাম আজম বাধ্য করেন তার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে। দলের প্রতি সুশৃঙ্খল অনুগত কর্মীরা নীরবে মেনে নিলেও অনেকেই এ সময় দল ছেড়ে যান।

জামাতকে পুনর্জাগরিত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও অনেকেই মওলানা রহীমকে নেতৃত্বে দেখতে চান। তারা বলেন, যেহেতু গোলাম আজম দেশের নাগরিক নন তাকে দলের নেতৃত্বে আনা ঠিক হবে না। এরপর গোলাম আজমের নির্দেশে মওলানা রহীমের এবং তার সঙ্গের অনেকের নাম পর্যন্ত দল থেকে খারিজ করে দেয়া হয়।

গোলাম আজম লন্ডন থেকে শুরু করেন ফেলে যাওয়া দলের সাথীদের সংগঠনের প্রক্রিয়া। মওলানা রহীম তার অবর্তমানে দায়িত্ব নেন বাংলাদেশে জামাতে ইসলামীকে পুনর্গঠনের। গোপনভাবে কাজ চলতে থাকে। লন্ডনে এ সময় জড়ো হতে থাকেন ১৯৭১-এ পালিয়ে যাওয়া দলের নেতা ও কর্মীরা, পূর্ব পাকিস্তান জামাতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম সাপ্তাহিক হিসেবে লন্ডনে প্রকাশিত হয়।

ইতিমধ্যে, এপ্রিল ১৯৭২ তার নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে। ১৯৭৬-এর ১৮ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকারের এক প্রেসনোটে বলা হয় যাদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে পারেন। গোলাম আজম সঙ্গে সঙ্গে লন্ডন থেকে নাগরিকত্ব ফিরে পাবার জন্যে দরখাস্ত করেন। ১৯৭৭ এবং ১৯৭৮ তিনি আবার দরখাস্ত করেন। ২০ মার্চ ১৯৭৮ সরকার তাকে নাগিরকত্ব প্রদানে অস্বীকৃতি জানান। ১১ জুলাই ১৯৭৮ তিনি পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়ে তিন মাসের ভিসায় ঢাকায় ফিরে আসেন। ভিসার আবেদনে উল্লেখ করেন তার মাতা অসুস্থ। অসুস্থ মাতাকে দেখার সুযোগ দেবার জন্যে মানবিক কারণে তাকে ভিসা প্রদান করা হয়।

আট বছর পর এলেন তিনি। কিন্তু বসে থাকতে পারলেন না। দলকে পুনর্গঠনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লেন। প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের এক পুনর্মিলনী সভায় অতিথিদের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করেন। তারপর নারায়ণগঞ্জ। সভা করতে পারেন নি প্রতিরোধের মুখে। জামালপুরে সভা করতে পারেন নি। এরপর ফরিদপুরে ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে তার জেলায় প্রবেশে বিধি নিষেধ আরোপিত করা হয়। তবুও গোপনে তার কার্যকলাপ চলতে থাকে।

১ জানুয়ারি ১৯৮১। বায়তুল মোকাররমে প্যালেস্টাইন মুক্তি বাহিনীর পক্ষে ইসরাইলীদের সঙ্গে যুদ্ধে দুজন বাংলাদেশী শহীদদের জানাজায় অংশগ্রহণে এলেন তিনি। জানাজা শেষে হঠাৎ উপস্থিত জনতা তাকে চিনে ফেলে। তাকে কয়েকজন মারধরও করে।

পাকিস্তানী নাগরিক হিসাবে নাগরিকত্ব বিবেচনাধীন থাকাকালীন হঠাৎ কেন তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশ নিচ্ছেন।

সমস্যায় পড়ে যান গোলাম আজম ১৯৭৩ সালে মওলানা রহীমের দেশে প্রত্যাবর্তন এবং জামাতের নেতৃত্ব গ্রহণের পর। মওলানা আবদুর রহীম গোপন দলের কাঠামো বজায় রেখে ‘ইসলাম পছন্দ’ ছয়টি দক্ষিণপন্থী দলের সমবায়ে ২৪ আগস্ট ১৯৭৬ গড়ে তোলেন ইসলামিক ডেমক্রেটিক লীগ। প্রাক্তন নেজামে ইসলাম নেতা মওলানা সিদ্দিক আহমদকে এ দলের সভাপতি নির্বাচিত করে মওলানা রহীম হন প্রথম সহ-সভাপতি। অবশ্য জামাতের নেতৃত্বে প্রাক্তন পিডিপি, খেলাফতে রব্বানী, ডেমক্রেটিক পার্টি ইত্যাদির সমবায়ে এ মোর্চা গঠনের প্রক্রিয়ায় এ দলগুলোও বিভক্ত হয়ে যায়।

কিন্তু মওলানা রহীম জামাতকে সংগঠিত করলেও প্রবাসী গোলাম আজমের সঙ্গে ক্রমাগত দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। দলের চরমপন্থীরা বাংলাদেশকে মেনে নেয়ার প্রশ্নে মওলানা রহীমের যৌক্তিকতাকে চ্যালেঞ্জ করেন। মওদুদীর অধিকাংশ বইয়ের অনুবাদক ও দলের অন্যতম তাত্ত্বিক মওলানা রহীমকে তারা অভিযুক্ত করতে থাকেন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ‘আঁতাতের’ জন্যে। এমনি পরিস্থিতিতে মওলানা সিদ্দিক আহমদ ও অন্যান্য অজামাতপন্থী দলগুলো বেরিয়ে যান জামাতের হস্তক্ষেপের কারণে ২৩ অক্টোবর ১৯৭৭।

গোলাম আজম ফিরে আসার পর মওলানা রহীমের সঙ্গে সংঘাত বেড়ে যায়। ১৯৭৯ সালের পার্লামেন্টারী নির্বাচনের পর আই, ডি, এল-এর ছয়টি আসন লাভের পর গোলাম আজম অনুভব করেন দলকে স্বকীয় রূপে নিয়ে আসতে হবে। তাছাড়া মওলানা রহীমের সঙ্গেও তার বিরোধ তীব্র হতে থাকে। এমনকি দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার পরিচালনা নিয়ে মারপিটও ঘটে। সম্পাদক আখতার ফারুককে পিটিয়ে বের করে দেয়া হয়।

২৫, ২৬, ২৭ মে ১৯৭৯ ঢাকায় জামাতে ইসলামীর বাংলাদেশে প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে। গোলাম আজমকে গোপনে আমীর নির্বাচিত করা হয় নাগরিকত্ব লাভ সাপেক্ষে। প্রকাশ্যে ইয়াহিয়া খানের শেষ গভর্নর আবদুল মালিকের অন্যতম মন্ত্রী আব্বাস আলী খানকে অস্থায়ী আমীর নির্বাচিত করা হয়। ফেব্রুয়ারি ১৯৮০ দলের পক্ষ থেকে দেশব্যাপী সাংগঠনিক পক্ষ পালন করা হয়। পাশাপাশি গোলাম আজমের নাগরিকত্ব পুনর্বহাল কমিটিও দাঁড় করানো হয়। সারা দেশব্যাপী পোস্টার প্রচারপত্র ও স্বাক্ষর অভিযান চালানো হয় গোলাম আজমের নাগরিকত্ব দাবি করে।

১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮০ প্রথমবারের মতো বায়তুল মোকাররমে জামাতে ইসলামীর জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সাত ডিসেম্বর ১৯৮০ দলের পক্ষে প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে আব্বাস আলী খান ৫ দফা দাবীনামা পেশ করেন। এ সাংবাদিক সম্মেলনে আব্বাস আলী খান বলেন, ‘১৯৭১ সালে দেশ ও জাতির মঙ্গলের জন্য যা করেছি ঠিকই করেছি ভারতীয় আগ্রাসনের হাত থেকে জনগণকে হেফাজত করার জন্যে’। এ বক্তব্য নাড়িয়ে দেয় দশ বছর আগেকার কালো অতীতকে। নতুন করে দৃষ্টি আবদ্ধ হয় জামাতের উপর।

১ মার্চ ১৯৮১ বায়তুল মোকাররমে ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ কায়েমের লক্ষ্যে ‘ইসলামী বিপ্লব’-এর ৭ দফা পেশ করেন আব্বাস আলী খান।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ২৫ মার্চ ’৮১ প্রদত্ত বক্তৃতায় ‘স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্যে প্রয়োজন হলে বাংলাদেশের মানুষ আবার অস্ত্র তুলে নেবে’ এবং ‘কতিপয় লোক স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল তাদের আমরা ভালভাবে চিনি। ১৯৭১-এ স্বাধীনতা বিরোধীরা কিছুই করতে পারেনি, আজ যারা বিদেশী অনুপ্রেরণায় স্বাধীনতাকে দুর্বল করতে চাচ্ছে তারাও কিছু করতে পারবে না, বাংলাদেশের মানুষ তাদের ধ্বংস করে দেবে।’ এ বক্তব্যের পূর্বাহ্নেই ২১ মার্চ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কর্তৃক ১ মে থেকে ‘রাজাকার আলবদর প্রতিরোধ’ সপ্তাহ পালনের ডাক দেয়। এর উত্তরে রংপুরে জামাত আক্রমণ করে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের অফিস। সারা দেশ হয়ে ওঠে প্রতিবাদ মুখর। এরপর ২৯ মার্চ আব্বাস আলী খান এক সাংবাদিক সম্মেলনে আবার ’৭১ এ আমরা যা করেছি ঠিকই করেছি’ এবং ‘একাত্তরে বাংলাদেশের কনসেপ্ট সঠিক ছিল না’ বলে পুনরায় তাদের অতীত ভূমিকা ব্যাখ্যা করেন। এ বক্তব্যে আবার তাদের প্রতি সবার দৃষ্টি আবদ্ধ হয়।

এই প্রত্যক্ষ চ্যালেঞ্জের পর বিভিন্ন স্থানে ঘটতে থাকে মুক্তিযোদ্ধা ও জামাতের সঙ্গে সংঘর্ষ।

মূলতঃ ৪০ বছরে জামাতে ইসলামী প্রতি দশ বছর পরপর বিভিন্ন বক্তব্যে জনগণের সঙ্গে কনফ্রনট্রেশনে আসছেন।
এ পরিস্থিতিতে তারা দলের ভবিষ্যৎ অতীতের নিরিখে কি নিরীক্ষা করবেন বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বাস্তবতার ভিত্তিতে না পুরানো অতীতকে নিয়ে আসবেন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে এটাই ১৯৮১-র প্রশ্ন।

২৫ মার্চ। ১৯৭১ মধ্যরাতে হঠাৎ গর্জে উঠলো বন্দুকের হিংস্রতা। এমন হিংস্রতা, ধ্বংসলীলা, হত্যাযজ্ঞ এই নীরব নিভৃত সবুজ-শ্যামল দেশ আর কখনও দেখেনি। এসব চলেছে শুধু ধর্মের নামে, যে ধর্মকে এদেশের মানুষ প্রাণের চেয়ে বড়ো বলে জেনেছে। কেবল ধর্মের নামে শোষণ-বঞ্চনা অব্যাহত রাখবে এদেশের মানুষের ওপর পরবর্তী ২৬৬ দিন চলেছিলো অমানুষিক বর্বরতা, যা নাদির শাহ চেঙ্গিজ খানের রক্তলোলুপতাকে ম্লান করে দিয়েছিলো। এই ২৬৬ দিন গোলাম আজম নাকি এ-দেশের মানুষের জান-মালের হেফাজত করেছিলেন। এ-কথা বলেন জামাতীরা। তারা স্বাধীনতা যুদ্ধকে বলেন গৃহযুদ্ধ। তারা নাকি শুধু ভারত বিরোধিতা করেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে বিরোধ নেই। তিনি বাংলাদেশকে ‘তথাকথিত’ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ‘দুষ্কৃতকারী’ বলেন। ২৬৬ দিন চালিয়েছিলেন জুলুম-হত্যা-ধর্ষণের অকথ্য বর্বরতা (এরা নাকি এসব করেছিলেন ইসলাম রক্ষার জন্যে)। দক্ষিণপন্থী দলগুলোর মধ্যে জামাত সবচেয়ে সংগঠিত অংশ হিসেবে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে শুধু সমর্থনই নয়, জনবল দিয়ে সহায়তা করেছে। জামাতের এদেশীয় এজেন্টরাই ছিলো সবচেয়ে ভয়ংকর। তাদের সদস্য রাজাকার, আলবদর ও আল শামস পাকসেনাদের নিয়ে যেতো জনপদে। ‘মুক্তি’ ধরার নামে চালাতো জুলুম, হত্যা। রাজাকার বাহিনীতে দলের বাইরের লোক বেশী থাকায় জামাত আলবদর ও আল শামস বাহিনী গঠন করে। এরা কাজ করে এক সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে। এবং এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তারা চরম নৃশংসতায় বহু কলঙ্কিত চিহ্নও রেখেছে। এদের পাকিস্তানের সূর্য অস্তমিত হওয়ার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জামাতীরা আদর্শ ভূমি ‘পাকিস্তানকে’ রক্ষার সকল প্রকার প্রচেষ্টা বা নীচতা হীনতা হিংস্রতা দেখিয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর সকালেও এরা রাজধানীতে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে গেল যাদের লাশ পাওয়া যায় বিভিন্ন বধ্যভূমিতে।

২৫ মার্চের পর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত কি ঘটেছে তার সাক্ষী বাংলার তৎকালীন সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রায় সকলেই এখনো জীবিত। তারা ঘটনাগুলোর সাক্ষী। তৎকালীন সময় সংবাদপত্রগুলো, অবরুদ্ধ সংবাদপত্রগুলোয় যেসব খবর ছাপা হয়েছে তারই ভিত্তি করে জামাতে ইসলাম ও গোলাম আজমের কার্যকলাপের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নীচে দেয়া হলো।

৮ এপ্রিল : পূর্ব পাকিস্তানের জামাতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আজম ও সাধারণ সম্পাদক এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন : ভারত পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে। তারা ঘোষণা করেন, ভারতীয় বা পাকিস্তান বিরোধী এজেন্টদের বা অনুপ্রবেশকারীদের যেখানেই দেখা পাওয়া যাবে দেশপ্রেমিক পূর্ব পাকিস্তানীরা তাদের নির্মূল করবে।
কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং স্বাধীনতাকামী জনগণের প্রতিরোধ যত তীব্র হতে থাকে জামাতীরা মিথ্যের আশ্রয় ততো নিতে থাকে। ১৯ মে পূর্ব পাকিস্তান জামাতের সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেক ও শ্রম সম্পাদক মোহাম্মদ শফিউল্লাহ এক যুক্ত বিবৃতিতে স্বদেশের পবিত্র মাটি থেকে পাকিস্তান বিরোধীদের উৎখাত করার আহ্বান জানান। তারা বলেন, আল্লাহর মেহেরবানীতে পাকিস্তান বিরোধী দুষ্কৃতকারী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ত্রাসের রাজত্ব খতম হয়েছে এবং পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে। গণহত্যার রক্তস্রোতে যখন নদীমাতৃক প্রান্তর রক্তে রক্তে লাল, নির্যাতিত-লাঞ্ছিত এদেশের অনেক পবিত্র মা-বোনেরা, তখন জুলাইয়ে জামাতের জেনারেল সেক্রেটারি আবদুল খালেক বিবৃতিতে সন্তোষ প্রকাশ করছেন এ বলে, সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী স্থানীয় এজেন্টদের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে গ্রাস করার ভারতীয় চক্রান্ত জনগণ পুরোপুরিভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তানের শত্রু দুষ্কৃতকারী বলে আখ্যায়িত করেন জামাত প্রধান মওলানা আবুল আলা মওদুদী। ১০ জুলাই ’৭১ লাহোরে পাকিস্তানের এই সংকটকালে জনসাধারণকে আল্লাহ ও রসুলে করীমের পথে অবিচল থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন যে, অন্যথায় শত্রু ও দুষ্কৃতকারীদের চক্রান্ত নির্মূল করা সম্ভব নাও হতে পারে। ৮১ সালের ২৪ মার্চ রংপুরে জামাতীরা মুক্তিযোদ্ধাদের উপর হামলা করে। এটা নতুন কিছু নয়। ৭১ সালের ১৩ জুলাই রংপুরে জামাতের ভারপ্রাপ্ত আমীর মিয়া তোফায়েল মোহাম্মদ মুক্তিযোদ্ধাদের দুষ্কৃতকারী ও পাকিস্তানের শত্রু বলেছিলেন এবং তাদেরকে খতম করার আহ্বান জানিয়ে ছিলেন।

১৫ জুলাই মিয়া তোফায়েল পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এবং ‘বেলুচিস্তানের কসাই’ নামে কুখ্যাত লেঃ জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন গভর্নর হাউসে। তার সঙ্গে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান জামাতে ইসলামের আমীর অধ্যাপক গোলাম আজম। এরপর ১৭ জুলাই কুষ্টিয়ায় মিয়া তোফায়েল সমাজবিরোধী ব্যক্তিদের (অর্থাৎ মুক্তিকামী জনগণকে) দমন করে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সেনাবাহিনীর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। ১৯ জুলাই করাচী ফিরে গিয়ে মিয়া তোফায়েল বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে এবং বিদ্রোহ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন সম্পূর্ণরূপে নির্মূল হয়েছে।

কিন্তু ‘বিদ্রোহ’ যে নির্মূল হয়নি, মুক্তিযোদ্ধাদের হানা তীব্রতর হচ্ছিলো তার প্রমাণ ২৫ জুলাই পূর্ব পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর জেনারেল সেক্রেটারী এবং কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কার্যনির্বাহক সদস্য আবদুল খালেক সীমান্ত এলাকা বরাবর ভারতের বিরামহীন উস্কানীমূলক তৎপরতার তীব্র নিন্দা করে এক বিবৃতি দেন।

৭১ সালে জামাত ঢাকায় মহা ঘটা করে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস পালন করে। এ দিন জামাতের তরফ থেকে বলা হয় : ২৪ বছর পাকিস্তানের আদর্শের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। তাই আজ পূর্ব পাকিস্তানের ঘরে ঘরে পাকিস্তানের দুশমন সৃষ্টি হয়েছে এবং তারা পাকিস্তানের পহেলা নম্বরের দুশমন ভারতকে বন্ধু বলে মনে করছে।

৮১ সালে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে যখন জামাতীরা বলেন, ৭১ সালে তাদের ভূমিকা সম্পর্কে জনগণের কোনো রিজার্ভেশন নেই বা গোলাম আজমের নাগরিকত্ব পুনরুদ্ধার কমিটি ৭১ সালে গোলাম আজমের ভূমিকা সম্পর্কে যখন বলেন : ‘ভীত-সন্ত্রস্ত জনতার মাঝে জীবনের নিরাপত্তাবোধ এবং দেশে আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্যে অধ্যাপক গোলাম আজমের সেদিনের বলিষ্ঠ ভূমিকা সর্বজনবিদিত। নিরীহ জনতার উপর টিক্কা খানের সামরিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনিই প্রথম সোচ্চার কণ্ঠে প্রতিবাদ করেছিলেন।’ তখন রাজনৈতিক মিথ্যা ভাষণ ছাড়া আর কিছুই মনে হতে পারে না। বক্তৃতা বিবৃতিই নয়, আলবদর-আলশামস সৃষ্টি করে সর্বস্তরের জনগণকে হত্যার করুণ স্মৃতিই মনে পড়ে। ৭১ সালের ১৪ আগস্টেও গোলাম আজম এক পাকিস্তানে বিশ্বাস করতেন। সেদিন এক বিবৃতিতে তিনি পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণের মধ্যে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব জোরদার করতে আন্তরিক চেষ্টার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, জাতি যে চরম সঙ্কটের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে এবারের স্বাধীনতা দিবস পালন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আমাদের আদর্শের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতাই জাতীয় সঙ্কটের মূল কারণ।’

এর চারদিন পরের বিবৃতিতে বোঝা যায় গোলাম আজম মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর কি পরিমাণ রুষ্ট ছিলেন। ১৮ আগস্ট লাহোরে তিনি বলেন, ভারত দুষ্কৃতকারীদের (৭১ সালে পাকিস্তানীদের ভাষায় মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন দুষ্কৃতকারী) সাহায্য করছে। তাই পাকিস্তানের উচিত কাল বিলম্ব না করে ভারত আক্রমণ করা এবং আসাম দখল করা।

লাহোরে গোলাম আজম গিয়েছিলেন জামাতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় অধিবেশনে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্যে আহূত বৈঠকে যোগ দিতে। ১৯ আগস্ট দলের সদর দফতরে নায়েবে আমীর মাওলানা আবদুর রহিম এ-বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। বৈঠকে ৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, ৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রস্তাবিত উপনির্বাচন, পাকিস্তানের ভাবী শাসনতন্ত্র, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কতিপয় বিদেশী শক্তির হস্তক্ষেপ, পূর্ব পাকিস্তানের বাস্তুহারা (ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী) লোকদের পুনর্বাসন ইত্যাদি বিষয় আলোচিত হয়।

২০ আগস্টের অধিবেশনে জামাত ভারতের অব্যাহত উস্কানী ও শত্রুতামূলক আচরণের প্রেক্ষিতে জেহাদের জন্যে সর্বাত্মক প্রস্তুতির আহ্বান জানায়। অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের আমীর গোলাম আজম ও সেক্রেটারী জেনারেল আবদুল খালেক বক্তৃতা করেন।

স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে ২৩ আগস্ট গোলাম আজম লাহোরে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে তা ভারত ও তার চরদের ষড়যন্ত্রেরই ফল। একমাত্র ইসলামের শক্তিই দেশের অখন্ডতা রাখতে পারে।

গোলাম আজম বলেন, ‘যারা জামাতে ইসলামীকে দেশপ্রেমিক সংস্থা নয় বলে আখ্যায়িত করছে তারা হয় জানে না বা স্বীকার করার সাহস পায় না যে, ইসলামের আদর্শ তুলে ধরা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরোধিতা করার জন্যেই কেবল পূর্ব পাকিস্তানে জামাতের বিপুল সংখ্যক কর্মী দুষ্কৃতকারীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে।’ জামাতের এই অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক জীবন ধারা পুনরুদ্ধার, মিলিতভাবে দুষ্কৃতকারীদের নির্মূল করার জন্যে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি আবদেন জানায়।

তাই ৮১ সালেও গোলাম আজম ‘এক পাকিস্তান’ না ‘স্বাধীন বাংলাদেশে’ বিশ্বাস করেন তা নিয়ে সন্দেহগ্রস্ত হওয়া স্বাভাবিক। জামাতের কাউন্সিলের পর ৭১ সালের ২৮ আগস্ট গোলাম আজম পেশোয়ারে বলেন, শুধুমাত্র ইসলামী আদর্শই দেশের (পাকিস্তানের) দুই অংশের ঐক্য বজায় রাখতে পারে। পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে জামাত নেতা পাকিস্তানের সংহতি রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করেন।

গোলাম আজম এরপর পাকিস্তানের রাজনৈতিক গতিধারা পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন। পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন, মন্ত্রীসভা গঠন, পাকিস্তানের শত্রুদের খতম করা ইত্যাদিতে তার ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। গোলাম আজমের এ পর্যায়ের ভূমিকা শুরু হয় আগস্ট থেকে, যখন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে কান্নার রোল, রাস্তা-ঘাট-নদী খালে স্বাধীনতাপ্রিয় নারী-পুরুষের লাশ, নির্জন জনপদ, সর্বত্র বিরাজমান ভয়-ভীতি সন্ত্রাসের ছাপ।

৭১ আগস্ট গোলাম আজম হায়দারাবাদে এক সাংবাদিক সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে সদস্যপদে নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবী জানান। এ প্রসঙ্গে গোলাম আজম বলেন, বেআইনী ঘোষিত আওয়ামী লীগের টিকেটে নির্বাচিত ও সরকার কর্তৃক বহাল ঘোষিত ৮৮ জন সদস্যের অধিকাংশই পাকিস্তানে নেই। তিনি বলেন, বর্তমান মুহূর্তের আশু প্রয়োজন হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে দেশপ্রেমিক ও ইসলাম-প্রিয় লোকজনের হাত শক্তিশালী করা। এ-সব লোক পূর্ব পাকিস্তানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাপকভাবে সাহায্যে করছে এবং দুষ্কৃতকারীদের রাষ্ট্র বিরোধী কার্যকলাপ ও বিদ্রোহীদের দমনে সেনাবাহিনী প্রশাসনকে পূর্ণ সহেযাগিতা দান করছে। অধ্যাপক গোলাম আজম দেশকে খ–বিখ- হওয়ার হাত থেকে রক্ষার জন্যে সেনাবাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসছে। পরদিন গোলাম আজম পূর্ব পাকিস্তানে সকল বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং তাদের নেতৃবৃন্দকে শাস্তি দেয়ার দাবী জানান।

তিনি এ প্রসঙ্গে ভাসানী ন্যাপ, আতাউর রহমান খানের জাতীয় লীগ, ওয়ালী খানের ন্যাপের পূর্ব পাকিস্তান শাখার নাম উল্লেখ করেন। তার মতে এসব দলের সদস্যরা এখনো পূর্ব পাকিস্তানে গোপন তৎপরতা চালাচ্ছে এবং জনগণের মধ্যে হতাশার ভাব সৃষ্টি করছে। অধ্যাপক গোলাম আজম বলেন, কোন ভালো মুসলমানই তথাকথিত ‘বাংলাদেশ আন্দোলনের’ সমর্থক হতে পারে না। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিমূর্ল করার জন্যে একমনা ও দেশপ্রেমিক লোকরা একত্রে কাজ করে যাচ্ছেন। রাজাকাররা খুবই ভালো কাজ করছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।

৩ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান জামাতের ডেপুটি আমীর মওলানা মুহম্মদ আবদুর রহীম, পূর্ব পাক জামাতের আমীর অধ্যাপক গোলাম আজম ও সাধারণ সম্পাদক এক যুক্ত বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পদে ডাঃ এ এম মালিকের (স্বাধীন বাংলা বেতারের চরমপত্রের ভাষায় ঠ্যাটা মালেইক্যা) নিয়োগকে অভিনন্দিত করেন এবং সরকারকে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা শাখা জামাতের সাধারণ সম্পাদক এক বিবৃতিতে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে ৬ সেপ্টেম্বর ‘পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা দিবস’ পালনের জন্য শাখাগুলোকে নির্দেশ দেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন : এদিন আমাদের পাকিস্তানের সংহতি ও অখন্ডতার জন্যে শপথ নিতে হবে।

১০ সেপ্টেম্বর গোলাম আজম এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের বিরোধিতা করার জন্যে গঠিত পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলটি গঠনের সমালোচনা করে বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতির গুরুত্বের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিনিধিদলটি যথাযোগ্যভাবে গঠিত হয়নি।

তিনি বলেন, প্রতিনিধিদলের তালিকায় হামিদুল হক চৌধুরী, বিচারপতি (অব.) এ কে এম বাকের, মৌলভী ফরিদ আহমদ, বিচারপতি হামদুর রহমান, ডঃ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, এ কিউ এম শফিকুল ইসলাম, খান এ সবুর, ফজলুল কাদের চৌধুরীর মতো ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত ছিলো।

১৭ সেপ্টেম্বর অপরাহ্নে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডাঃ মালেক ১০ সদস্যের মন্ত্রী পরিষদের ৯ জনের শপথ গ্রহণ করেন। এরা এর আগে কখনো মন্ত্রীত্ব করেননি। মন্ত্রীদের মধ্যে ২ জন জামাতে ইসলামেরÑ মওলানা আব্বাস আলী খান (বর্তমান বাংলাদেশ জামাতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর) এবং মওলানা এ কে এম ইউসুফ (বর্তমান জামাতের নায়েবে আমীর)। ২০ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক গোলাম আজম এক বিবৃতিতে গভর্নরের মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের আন্তরিক অভিনন্দন জানান। ২৪ সেপ্টেম্বর জামাত মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের এক সংবর্ধনা দেয়। এখানে গোলাম আজম বলেন, জামাতের কর্মীরা মুসলিম জাতীয়তাবাদের আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদকে মেনে নিতে রাজী নয়। ২১ সেপ্টেম্বর গোলাম আজম এক বিবৃতিতে উদ্ধাস্তুদের (ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী পূর্ব পাকিস্তানী) জীবন নিয়ে ছিনিমিনি না খেলতে এবং তাদের দেশে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ দানে ভারতকে বাধ্য করার জন্যে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রতি আকুল আবেদন জানান।
৭১ সালের ইয়াহিয়ার দোসর হয়ে পাকিস্তানকে অখ- রাখার সর্বশেষ প্রচেষ্টা জামাত চালায় অক্টোবর, নবেম্বর, ডিসেম্বরের ১৭ পর্যন্ত। অবরুদ্ধ সংবাদপত্রে যে চিত্র পাওয়া যায় তাতে নির্বাচন-নির্বাচন খেলা, গোলাম আজম ও জামাতের তৎপরতা এবং আলবদর, আল-শামসের কার্যকলাপের একটি খ-িত চিত্র পাওয়া যায়। নেপথ্য প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, রাস্তা-ঘাটে-গ্রাম-গঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের অসম সহাসিকতা এবং স্বাধীনতা প্রিয় জনগণের অসহযোগিতার চিত্র পাওয়া না গেলেও দশ বছর আগের সংবাদপত্রগুলো মূল্যবান দলিল।

৩ অক্টোবর ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর মজলিশে সুরার বৈঠক শুরু হয়। সুরা আশা প্রকাশ করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পরিচালনাধীনে যে শাসনতন্ত্র প্রণীত হচ্ছে তাতে আইন কাঠামোর নীতিগুলো তথা ইসলামী ব্যবস্থার প্রধান ধারাগুলো বিশ্বস্ততার সঙ্গে অনুসৃত হবে। এদিন মজলিশে সুরার উদ্বোধনকালে সংগঠনের আমীর গোলাম আজম জনগণের প্রতি পবিত্র আদর্শ আবাসভূমি পাকিস্তান রক্ষার জন্যে সব রকমের ত্যাগ স্বীকারের আবেদন জানান।

৬ অক্টোবরের বৈঠকে জাতীয় প্রাদেশিক পরিষদের শূন্য আসনগুলোতে আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আরেকটি প্রস্তাবে গভীর দুঃখ প্রকাশ করে বলা হয় : পাকিস্তান বিরোধী ব্যক্তি ও ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের নৃশংসতার শিকার পূর্ব পাকিস্তানের সাত কোটি মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ব্যর্থ হয়েছে।
জামাত প্রধান মওলানা মওদুদী ৮ অক্টোবর পূর্ব পাকিস্তানী ছাত্র সমাজের প্রতি দেশের পবিত্র মাটির প্রতি ইঞ্চি রক্ষার জন্যে সব রকমের ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, পাকিস্তান রক্ষা পেলে ইসলাম রক্ষা পাবে। কেননা, পাকিস্তানই বিশ্বে ইসলামের সবচেয়ে বড় দুর্গ।

ইতোমধ্যে জনাব ভূট্টো পূর্ব পাকিস্তানে বামপন্থীদের আলবদররা-আল-শামসরা হত্যা করছে বলে অভিযোগ করে একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। ঢাকা থেকে ১৩ অক্টোবর গোলাম আজম তার জবাব দেন। তিনি বলেন, প্রতিটি পূর্ব পাকিস্তানীই জানে অন্য কারো চেয়ে জনাব ভূট্টোই হচ্ছেন প্রধান অপরাধী। পূর্ব পাকিস্তানীদের দুঃখ-দুর্দশায় জনাব ভূট্টোর অশ্রুপাতের খবরটি আমি খুবই উপভোগ করেছি। এরপর ১৬ অক্টোবর বায়তুল মোকাররমে ‘তৌহিদী’ জনতার এক সভায় অধ্যাপক আজম ‘তথাকথিত বাংলাদেশের’ ভুয়া শ্লোগানে কান না দিয়ে পাকিস্তানকে নতুনভাবে গড়ে তোলার আহ্বান জানান। বর্তমান পরিস্থিতির উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানে এখন জানমাল-ইজ্জতের কোনো নিরাপত্তা নেই। এ পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্যে তিনি প্রথমে মওলানা ভাসানী, যাদু মিয়া, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ এবং তাদের পার্টি ও ছাত্র সংগঠন, আতাউর রহমান খান ও শাহ আজিজুর রহমান, দ্বিতীয়ত জনাব ভূট্টো এবং তৃতীয়ত শেখ মুজিবের অদূরদর্শিতাকে দায়ী করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নূরে আলম সিদ্দিকী ও আ স ম আবদুর রবের মধ্যেকার বিরোধিতার কথা উল্লেখ করে বলেন, নূরে আলম সিদ্দিকী এক পাকিস্তানের পক্ষপাতী ছিলো, কিন্তু আ স ম রব বিচ্ছিন্নতার শ্লোগান তুলছিলো। তিনি আরো বলেন, একথা অনস্বীকার্য যে, ৭০ সালে জনগণ শেখ মুজিবকে ভোট দিয়েছিলো। কিন্তু নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। তাই তাদের সদস্যপদ থাকার প্রশ্নই ওঠে না।

নভেম্বর মাসে প্রাদেশিক পরিষদ-এর তথাকথিত উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের নামে জামাতসহ বিভিন্ন দল আসনগুলো ভাগ-ভাটোয়ারা করে নেয়। প্রতিটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ৪ নবেম্বরের খবর : প্রাদেশিক পরিষদ উপ-নির্বাচনে জামাতে ইসলামীর যেসব প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন, তারা হচ্ছেন, জবানউদ্দিন (রংপুর), মওলানা তমিজউদ্দিন (দিনাজপুর), আবদুল্লাহ আল-কাফী (দিনাজপুর), আব্বাস আলী খান (বগুড়া), মওলানা আবদুস সোবহান (পাবনা), আফাজউদ্দিন আহমদ (রাজ), সা’দ আহমদ (কুষ্টিয়া), মওলানা এ কে এম ইউসুফ (খুলনা), মওলানা আবদুর রহিম (বাখরগঞ্জ), আধ্যাপক গোলাম আজম (টাঙ্গাইল), অধ্যাপক এ খালেক (টাঙ্গা), মোহাম্মদ এস এম ইউসুফ আলী (ময়মন), ইউসুফ আলী (ঢাকা) ও মোহাম্মদ সফিকুল্লাহ (নোয়াখালী)। উল্লেখ্য, প্রাদেশিক পরিষদে দু’পর্যায়ের উপনির্বাচনের কর্মসূচী মোতাবেক নির্বাচিত ৭৬ জন প্রার্থীর মধ্যে জামাতের প্রার্থীর সংখ্যা ১৯ জন অর্থাৎ ৪০ শতাংশ। তবে সেই বিভীষিকাময় সময়েও জামাতের প্রার্থীদের সম্পর্কে সংবাদপত্রে বলা হয় (দৈনিক পাকিস্তান, ৬ নবেম্বর) এ পর্যন্ত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত জামাতের ১৫ জন এমএনএ-ই বিগত সাধারণ নির্বাচনে পরাজয় বরণ করেছিলেন। এরা হচ্ছেন : প্রাদেশিক জামাতের আমীর অধ্যাপক গোলাম আজম, প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী আব্বাস আলী খান, প্রাদেশিক রাজস্ব মন্ত্রী মওলানা এ কে এম ইউসুফ, নিখিল পাকিস্তান জামাতের নায়েবে আমীর মওলানা আবদুর রহীম প্রমুখ।

৬ নবেম্বর জামাতের আমীর এক বিবৃতিতে ৭ নবেম্বর যথাযোগ্য মর্যাদায় ‘আলবদর দিবস’ পালনের জন্যে সকলের প্রতি আহ্বান জানান। ৮ নবেম্বর ঢাকা জেলার ইউনিয়ন ও থানা শাখার জামাতের সভাপতিদের এক সভায় দেশের অভ্যন্তরে দুষ্কৃতকারীদের হামলা, সীমান্তে আক্রমণাত্মক কার্যকলাপ পরিচালনার জন্যে ব্রাহ্মণ্য-সাম্রাজ্যবাদী ভারতকে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়। সভায় দৃষ্কৃতকারী পাঠিয়ে হিংসাত্মক ও মানবতাবর্জিত কার্যকলাপ থেকে ভারত বিরত না হলে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা অমিততেজী পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে ভারতীয় যুদ্ধবাজদের চরম শিক্ষাদান এবং তাদের অস্ত্রবলকে স্তব্ধ করে দেবে বলে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়। সিদ্দিকবাজারে অনুষ্ঠিত এ সভায় আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের আরো সচেতন ও কর্তব্যপরায়ণ এবং সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করা হয় এবং দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানানো হয়। ১০ নবেম্বর পাকিস্তান জামাতের নায়েবে আমীর মওলানা আবদুর রহীম গভর্নর ডাঃ মালেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং প্রদেশের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। তার দল এ ব্যাপারে সরকারকে যে কোনো রকম সাহায্য-সহযোগিতা করবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।

একইদিন প্রাদেশিক জামাতের সম্পাদক আবদুল খালেক পিপিপির মওলানা কওসার নিয়াজীর লাহোরে এক সাম্প্রতিক সাংবাদিক সম্মেলনে আলবদর-আল শামসদের সমালোচনার প্রতিবাদ করে এ ব্যাপারে সামরিক কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, আলবদর ও মুজাহিদরা দেশের সংহতির জন্যে সামরিক কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে পিপিপি নেতার এ অভিযোগ আমাদের শত্রু ও ভারতেরই হাতকে শক্তিশালী করছে।

১২ নবেম্বর এ প্রসঙ্গে অরেকটি বিবৃতিতে অধ্যাপক গোলাম আজম পূর্ব পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে সাহায্য করার জন্যে বামপন্থী দলগুলোর বিরুদ্ধে তার অভিযোগ খ-ন না করে বরং তারই (গোলাম আজম) বিরুদ্ধে আলবদর সম্পর্কে দুঃখজনক বিবৃতি দেয়ায় পিপলস পার্টির মিয়া মাহমুদ আলী কাসুরির সমালোচনা করেন।

একদিকে সমালোচনা, অন্যদিকে প্রদেশে জামাতের প্রধান গোলাম আজমের নেতৃত্বে আলবদর ও আলশামসদের সংগঠিত করার কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন জামাতীরা। শুধু তাই নয় পরবর্তী দিনগুলোতে ও তাদের কার্যকলাপ অত্যন্ত লক্ষণীয়। এক পাকিস্তানের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের দৃঢ়বিশ্বাস এবং বাক্যের কোরামিন অব্যাহত থাকে। অব্যাহত থাকে মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতাকামী জনগণের ওপর জুলুম, ধরে নিয়ে গুম করে দেয়া, নারী নির্যাতন ও জ্বালানো-পোড়ানোর সন্ত্রাসী নীতি।

১০ নবেম্বর রাজস্বমন্ত্রী মওলানা এ কে এম ইউসুফ সাতক্ষীরায় স্থানীয় অফিসার ও রাজাকারদের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। মন্ত্রী জাতির প্রতি তাদের সেবার উচ্চ প্রশংসা করে আরো উদ্দীপনার সঙ্গে তাদের কাজ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। সেদিন স্থানীয় পৌরসভার মিলনায়তনে এক জনসভায় তিনি বলেন, যদি ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করে তবে সে উপযুক্ত শিক্ষা পাবে। এর আগে তিনি ভারত থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনকারীদের জন্যে ‘অভ্যর্থনা কেন্দ্র’ পরিদর্শন করেন এবং প্রত্যাবর্তনকারীদের উদ্দেশে ভাষণ দেন। এখানে তিনি বলেন, তথাকথিত বাংলাদেশ হচ্ছে শূন্যের ওপর কেল্লা তৈরি করা। পাকিস্তান টিকতে এসেছে, ভাঙলে আবার জোড়া লাগবে।

১৩ নবেম্বর শিক্ষামন্ত্রী আব্বাস আলী খান চাঁদপুরে এক সমাবেশে বলেন, আমাদের সীমান্ত এলাকায় গোলাবর্ষণ করে ভারত শিশু ও নারীসহ নিরপরাধ লোককে হত্যা করছে। একে ‘জঘন্য কার্যকলাপ’ বলে অভিহিত করে তিনি তীব্র নিন্দা করেন। হাসান আলী হাইস্কুলের ছাত্র ও শিক্ষকদের সমাবেশে ‘আমাদের পবিত্র মাটির প্রতি ইঞ্চি রক্ষার জন্যে’ ছাত্রদের তৈরি হতে বলেন। জাতীয় পরিষদের তথাকথিত উপনির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বন্ধু ও শুভাকাক্সীদের কাছ থেকে বহু চিঠি ও তারবার্তা পেয়েছেন এ তথ্য জানিয়ে, ১৪ নবেম্বর এক বিবৃত্তিতে অধ্যাপক গোলাম আজম বলেন, ‘খাঁটি গণতান্ত্রিক পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ পরিবেশে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের দ্বারা আমার দেশ শাসিত হোক তা দেখার জন্যে আমি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করছি।’ পরদিন অধ্যাপক গোলাম আজম আরেকটি বিবৃতিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্বের পদ একজন পূর্ব পাকিস্তানীকে প্রদানের জন্যে দাবী জানান।

২৩ নবেম্বর লাহোরে গোলাম আজম রাজনৈতিক দলাদলি ভুলে গিয়ে কার্যকরভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্যে দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। লাহোরে তাকে দেয়া এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।

দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় যোগদানের উদ্দেশ্যে তিনি লাহোরে গিয়েছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে গোলাম আজমের এই ছিলো শেষ যাওয়াÑহয়তো কর্মীদের পরিত্যাগ করে পলায়ন। তার সঙ্গে ছিলেন মওলানা আবদুর রহীম ও মওলানা এ কে এম ইউসুফ। গোলাম আজম এর দীর্ঘ সাত বছর পর বাংলাদেশে প্রবেশ করতে সক্ষম হন ৭৮ সালের ১১ জুলাই। তার আগে অবশ্য মওলানা রহীম আসতে পারেন। বর্তমানে তিনি সংসদে আইডিএল দলের সদস্য। আর মওলানা ইউসুফ বাংলাদেশ জামাতের নায়েবে আমীর।

২৭ নবেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে গোলাম আজম বলেন : পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক ভারতের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত লড়ে যাবে এবং তাদের পবিত্র মাতৃভূমির এক ইঞ্চি জমিও ভারতকে দখল করে নিতে দেবে না।

২ ও ৩ ডিসেম্বর গোলাম আজম সম্পর্কে সর্বশেষ সংবাদ প্রকাশিত হয়। এপিপির খবর লাহোর থেকে : ১ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে লাহোরে ফিরে এসে গোলাম আজম বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ কখনো তাদের দাবির প্রতি মিসেস গান্ধীর সমর্থন চায়নি। এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আজম বলেন যে, পাকিস্তানের অস্তিত্বের জন্যে অবিলম্বে ভারতের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করা উচিত।

৭১ সালে কতজন জামাতী মারা গিয়েছিলো?

১৯৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধে মাত্র ২৭ জন রোকন মারা গেছে। রোকন জামাতে ইসলামীর সবুজ কার্ডধারী সদস্যের নাম। এরাই পার্টির মূল সদস্য। জামাতের ভাষায় : তারা শহীদ হয়েছে। ১৯৭৭ সনের শেষ দিকে জামাতে ইসলামী বাংলাদেশব্যাপী এক জরিপ চালায়। জরিপের উদ্দেশ্য ছিল : মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের কতজন মুত্তাফিক, কর্মী ও রোকন মারা গেছে তা জানা। তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি কেন্দ্রীয়ভাবে এই জরিপ পরিচালনা করে। জেলা, মহকুমা ও থানা পর্যায়ে এই জরিপ পরিচালনায় সহায়তা করে বর্তমান মুত্তাফিক, কর্মী ও রোকনগণ। দীর্ঘ এক বছর গ্রাম-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে ভ্রাম্যমাণ জরিপ টিম যে রিপোর্ট পেশ করে তা প্রায় চারশ পৃষ্ঠার। কেন, কখন, কীভাবে এবং কারা হত্যা করেছে বা মারা গেছেন তার বিস্তারিত বিবরণ এতে স্থান পায়। মুত্তাফিক, কর্মী ও রোকনরা মারা যাবার পর তাদের লাশ দাফন হয়েছে কিনা বা লাশের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল কিনা তাও লিপিবদ্ধ রয়েছে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ও বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে এই রিপোর্টে। জামাতের একটি সূত্র জানায়, বর্তমানে এই রিপোর্ট নিয়ে চলছে পর্যালোচনা। অধ্যাপক গোলাম আজমের সভাপতিত্বে নবেম্বর (৮০) মাসে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে মৃত মুত্তাফিক, কর্মী ও রোকনদের পরিবারের সদস্যদের সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। প্রতি মাসে এ সমস্ত পরিবারের সদস্যরা ভাতা পাবেন।

রিপোর্টের এক স্থানে বলা হয় : ‘আমাদের বীর সাথীরা জীবন দিয়েছে তবু তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধাদের (জারজ সন্তান) কাছে আত্মসমর্পণ করেনি।’ কুষ্টিয়ার গ্রামে তথাকথিত এক রোকনের মৃত্যু সম্পর্কে রিপোর্টে বলা হয় : ‘আমাদের দুজন সাথী বিশ্বাসঘাতকতার দরুন জারজ সন্তানরা হত্যা করতে পেরেছে, না হলে সেটা সম্ভব হতো না। বিস্তারিত বিবরণে জানা যায় : এই রোকন ঐ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যকারী দুই ব্যক্তিকে দিনে-দুপুরে হত্যা করে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল, পাশের গ্রামেই ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধারা। খবর পেয়ে তারা এই রোকন (জামাত সদস্য)কে ঘেরাও করে হত্যা করে। এই হত্যাকান্ডের জন্য জামাতের কতিপয় সদস্যকে দায়ী করা হয়। ১৯৭১ সনে যারা রোকন ছিল তাদের অনেকেই রোকন সদস্যপদ হারিয়েছে এই রিপোর্টের ভিত্তিতে। রিপোর্ট পাবার পর কেন্দ্র থেকে নির্দেশ গেছে এদের সদস্যপদ খারিজের। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ : তারা এলাকার জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না এবং দলের নির্দেশমত কাজ করে না।
রিপোর্টে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীর নাম স্থান পেয়েছে। কোন দল কিভাবে কাজ করছে এবং কোন দলের অবস্থা কি রকম তারও উল্লেখ রয়েছে। সরাসরি রাজনীতি করেন না অথচ রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিগত তালিকা রয়েছে এই ৭৭ সালের রিপোর্টে।

লন্ডনের একটি বাড়িতে

১৯৭৪ সনের প্রথম দিকে পূর্ব লন্ডনের একটি বাড়িতে গোলাম আজম বাংলাদেশ বিরোধী তৎপরতার নীল নকশা পেশ করেন। এই বৈঠকে কয়েকজন পাকিস্তানী নাগরিকও উপস্থিত ছিলেন। লন্ডন থেকে বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া খবর : এই বৈঠকে এটি সাদী, তোয়াহা বিন হাবিব, আলী হোসেন, ব্যারিস্টার আখতার উদ্দিন, মেহের আলী ও ডঃ তালুকদার প্রমুখ ব্যক্তিগণ উপস্থিত ছিলেন। পাকিস্তানী নাগরিকের মধ্যে মাহমুদ আলীর নাম উল্লেখযোগ্য। বৈঠকে গোলাম আজম বলেন : লন্ডনে বসে আমাদের কাজ চালানো কঠিন হবে। তাই দেশে যেতে হবে কাউকে। ঝুঁকি নিতে হবে, তা না হলে কিছু হবে না। অবশ্য আপনারা দেশে গেলে লোক পাবেন, আমি যোগাযোগ করেছি। সবই ঠিক আছে। একটা ছাপানো লিফলেট সকলের হাতে দিয়ে বলেন : এই লিফলেট গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে দিতে হবে। আমাদের সঙ্গে জনগণ রয়েছে। এই লিফলেটে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠনের কথা উল্লেখ ছিল বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। লিফলেটসহ কয়েক ব্যক্তি সে সময় ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জে ধরা পড়েছিল বলে জানা যায়। লিফলেটের সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু জানা যায়নি তবে একটি সূত্র জানায় : এই লিফলেটে ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত করার জন্য মসজিদে মসজিদে তৎপরতা শুরু করার আহ্বান ছিল। গোলাম আজম সে বৈঠকে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ ও পাকিস্তানের সহযোগিতার কথা জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন : টাকার কোনও অভাব হবে না। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আপনারা কাজ করে যান। কিভাবে কাজ করতে হবে তার একটি পরিকল্পনা ছিল নিম্নরূপ : বুদ্ধিজীবী মহলকে ‘জামাতের’ সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা দিতে হবে, ইসলামী বইপত্র ছাপাতে হবে, জনগণের যে কোনো আন্দোলনে সমর্থন দিতে হবে প্রয়োজনে টাকা-পয়সা দিয়ে আন্দোলনকে ব্যাপক করতে হবে।
দীর্ঘক্ষণ বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত হয়, দুজন সদস্য কাগজ-পত্র ও প্রয়োজনীয় টাকা-পয়সা নিয়ে বাংলাদেশে ফিরবেন। এই বৈঠকের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত করে জানা যায়নি তবে এদের কেউ কেউ এখন ‘ভাল পজিশনে’ সমাসীন আছেন বলে জানা যায়। এরা বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণার দাবী জানান।

জানা গেছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে বিধ্বস্ত মসজিদ পুনর্গঠনের দাবী জানিয়ে গোলাম আজম ৪৫ লক্ষ রিয়াল সংগ্রহ করেন। এ টাকার একটি অংশ দিয়ে গোলাম আজম যুক্তরাজ্যের ম্যানচেষ্টারের ১ নং এ্যাকস্ব স্ট্রীটে একটি বাড়ি কেনেন। বর্তমানে এ বাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন তারই পুত্র ইঞ্জিনিয়ার মেহদী হাসান।

মধ্যপ্রাচ্যের সে দেশটি ছেড়ে যাবার সময় গোলাম আজম সেখানে তার প্রতিনিধি হিসাবে নিযুক্ত করে যান কুমিল্লার চাঁদপুরের তোয়াহা বিন হাবিবকে। ১৯৭৭ সালের ৩০ জুলাই এরা লন্ডনের হোলি ট্রিনিটি চার্চ কলেজে আবার মিলিত হন। সেখানে গোলাম আজমই ছিলেন প্রধান বক্তা। এ সভায় গোলাম আজমের নাগরিকত্ব বহালের দাবী জানিয়ে বক্তৃতা করেন নোয়াখালীর লক্ষ্মীপুরের মাওলানা নাসিরুদ্দীন আহমেদ। ’৭১ সালে তাকে পাকিস্তান সরকারের খরচে বিদেশে পাঠানো হয় বাংলাদেশ বিরোধী জনমত সংগ্রহে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ইনি লন্ডনে এসে আস্তানা গাড়েন।

প্রায় একই সময়ে গোলাম আজমের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেন পাকিস্তানের এককালীন তথ্যমন্ত্রী আলতাফ গওহার ও তৎকালীন পিপিআই প্রধান মোয়াজ্জেম আলী। এদেরই প্রেরণায় ৭৭ সালের মে মাসে বিবৃতি দিয়ে গোলাম আজম ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ হজ্ব প্রতিনিধি দলের দুজন সদস্য বিচারপতি বাকের ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ডঃ বারী সৌদী আরবে গোলাম আজমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বলে জানা যায়।

ডকুমেন্টেশন সেন্টার নামক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও বাংলাদেশ বিরোধী প্রচার কাজ চালানো হয়। এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ছিলেন জনৈক ডঃ তালুকদার। বিদেশী পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত বাংলাদেশ বিরোধী খবরের কাটিং এক সঙ্গে করে ছাপিয়ে বের করাই ছিল উদ্দেশ্য। এই সমস্ত কাটিং সমৃদ্ধ কাগজপত্র বাংলাদেশের বিভিন্ন বার লাইব্রেরীতে পাঠানো হতো, জাতীয় প্রেস কাবেও কয়েকবার এসেছে। লন্ডন যড়যন্ত্রের সঙ্গে আরো যারা জড়িত ছিলেন তাদের মধ্যে মাওলানা মান্নান, মাওলানা ইউসুফ, খাজা খয়ের উদ্দিন ও কাজী কাদের প্রমুখ। এদের কেউ কেউ দেশেও ছিলেন।

জামাত একটি ফ্যাসিস্ট শক্তি

জামাত দয়ামায়াহীন একটি ফ্যাসিস্ট শক্তি। জামাতের ৪০ বছরের ইতিহাসে ফ্যাসিজমের অজস্র প্রমাণ রয়েছে। ইসলামই দলটির আদর্শে এ কথা প্রচার করা হলেও, মহান শান্তির ধর্ম ইসলামের উদারতা, বিশালতা, সহনশীলতার বিন্দুমাত্র চিহ্ন এদের কার্যকলাপে পাওয়া যায় না যখন তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করে। বিরোধী শক্তি ইসলামী-অনৈসলামী যাই হোক, তারা জামাতের ভাষায় ‘কাফের’। এবং কাফের খতম করা প্রকৃত মোমিনের পরিচয়। পরমতসহিষ্ণুতা এদলের রাজনৈতিক অভিধানে নেই। ইসলামের নামে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল, ইসলামী বিপ্লব এবং ইসলামী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এ দলের লক্ষ্য হলেও জামাতের পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে রাজতান্ত্রিক শক্তি। রাজতান্ত্রিক শক্তিগুলো এ দলকে শুধু অঢেল পেট্রো-ডলারই নয়, সব ধরনের সহায়তা দেয়। শুধু তাই নয়, রাজতান্ত্রিক কিছু দেশ জামাতের কার্যকলাপ নির্বিঘœ করার জন্যে নানা ধরনের চাপও দেয়। অথচ ইসলাম রাজতন্ত্র বিরোধী ধর্ম। তাই স্বাভাবিক কারণে প্রশ্ন জাগে জামাতে ইসলামী কি সত্যিকারের ইসলামপন্থী? তারা কি ইসলামী প্রজ্ঞা, বিজ্ঞানমনস্কতা, উদারতা, সহনশীলতা ইত্যাদি গুণাবলীর প্রবক্তা? এ প্রশ্নে যে কোনও জামাত কর্মী তখনই জবাব দেবেনÑ ‘হ্যাঁ।’ কারণ, জামাতের রাজনৈতিক শিক্ষায় ইসলামী দর্শন চর্চার ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করা হয়। তাহলে জামাত নিজ ধর্মের ভ্রাতার হত্যাকারী, ভাই-বোনের ওপর জুলুমকারী হচ্ছে কেনো? এ প্রশ্নের উত্তরে ইসলামপন্থী দলগুলোরই মন্তব্য : এ দলের স্রষ্টা মওলানা মওদুদী ইসলামের বিকৃত-কুৎসিত ব্যাখ্যাই দিয়ে দিয়েছেন। ৫১ সালে জামাতের ইতিহাসে ফ্যাসিবাদী তৎপরতায় কলংকিত তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান বা বর্তমান পাকিস্তানে জামাত ‘আহমদিয়া’দেরকে অমুসলিম বা কাফের আখ্যায়িত করে নির্বিচারে হত্যা করেছিলো। ৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জামাতে ইসলামীর ভূমিকা পাক-বাহিনীর নির্মমতা-নৃশংসতাকেও ম্লান করে দিয়েছিলো। বদর যুদ্ধের মোজাহিদদের স্মরণে গড়া আলবদরের নাম এখনো আতঙ্ক সৃষ্টি করে। জামাতের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মীদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গড়া হয়। হত্যাই ছিলো আলবদরের একমাত্র ও শেষ নীতি। নারী নির্যাতনের অজস্র করুণ ঘটনা শুনে কান্না আসে চোখে। এ সমস্ত বর্বর ফ্যাসিবাদী নৃশংসতা জামাত করেছিলো ধর্মেরই নামে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আলবদর, আলশামস বাহিনী গা ঢাকা দেয়। স্বাধীনতার বিরোধিতার অভিযোগে অন্যান্য দলের সঙ্গে জামাতও নিষিদ্ধ হয়ে যায়। মাত্র একজন অজামাতী রাজাকারের বিচার হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে। গা ঢাকা দেয়ার পর জামাতীরা নিষ্ক্রিয় ছিলো না। ৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত বহু নাশকতামূলক ঘটনার সঙ্গে এরা জড়িত ছিলো বলেও সাধারণ্যে সন্দেহ বিদ্যমান। এ সময়ে জামাত ইসলামপন্থী বিভিন্ন দলের ওপর নানা ধরনের জুলুম করে। ৭৬ সালের পর তাদের জুলুমের নানা ধরনের ঘটনা আরো ব্যাপকভাবে জানা যায়। ৮০ সালে আলীয়া মাদ্রাসায় জামাতীদের হামলার পরিণতিতে কজন ছাত্র নিহত হন। খুব বেশি দিনের কথা নয় নোয়াখালীতে সর্বজনমান্য বুজুর্গ হযরত মওলানা হাফেজ মোহাম্মদউল্লাহর (হাফেজ্জী হুজুর)-এর এক সভায় জামাতীরা হামলা চালায়। কিন্তু ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রতিরোধের ফলে তাদের অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়। সাম্প্রতিককালে জামাতীরা আরো সাহস সঞ্চয় করে দেশের রংপুর, রাজশাহী, বরিশালসহ বিভিন্নস্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা চালায়।

জামাতীদের বর্তমান রাজনৈতিক তৎপরতা ও মতলব সম্পর্কে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামÑবাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক মওলানা শামসুদ্দীন কাসেমী ১১ এপ্রিল এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘জামাতীরা ইরানের খোমেনী স্টাইলে বিপ্লব ঘটিয়ে এ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমান ও রাজনৈতিক কর্মীদের রক্তগঙ্গা প্রবাহিত করার নীল-নকশা তৈরি করছে। এ অভিযোগ করে সর্বস্তরের মানুষ সতর্ক থাকার জন্যে আহ্বান জানান। বিবৃতিতে তিনি জামাতে ইসলামী তথা মওদুদীপন্থীদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্যে দেশবাসীর প্রতি আবেদন জানিয়ে বলেছেন যে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যে এরা এবারও ধর্মের নামে পুরোনো পদ্ধতি অবলম্বনে ত্রুটি করছে না। এতে তারা লাভবান হোক বা না হোক, এ বিতর্কে না গিয়েও বলা চলে যে এতে ইসলাম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর জামাতে ইসলামীদের হামলা প্রসঙ্গে দু’পক্ষ ও বিভিন্ন মহলের বিবৃতি পাল্টা বিবৃতির প্রতি তাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে এ কথা জানিয়ে তিনি বলেন যে, প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে কেউ কেউ জামাতের লোক ও আলেম সমাজসহ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে বিরাজমান ব্যবধানটুকু সম্পর্কে কোনও ধারণাই রাখেন না। ফলে জামাতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে আলেম সমাজ ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনেও অনেকে আঘাত দিয়েছেন। তিনি বলেন, জামাতে ইসলামী সম্পর্কে আমাদের নতুন করে কিছু বলার নেই। এই দলটি ইসলামের নামে ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখছে। আসলে ইসলামের সঙ্গে এদের আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই। এরা পাঞ্জাবের মওদুদীর বিকৃত চিন্তাধারার ধারক ও বাহক বলে মন্তব্য করে তিনি জানান যে, এদের সম্পর্কে এ দেশের সর্বস্তরের ওলামায়ে কেরাম বারবার তাদের মত প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, জামাতে ‘ইসলামী যখনই অন্য কোনো দলের সঙ্গে রাজনৈতিক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে, তখনই তারা সেটাকে ‘ইসলাম ও কাফেরের লড়াই’ রূপে প্রকাশ করার অপচেষ্টা করেছে। বর্তমানেও তারা এই পুরোনো পদ্ধতি অবলম্বন করতে ত্রুটি করেনি।
তিনি আরো বলেন, জামাত ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলো যে চরমপন্থী এও কোনো নতুন কথা নয়। এরা যে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে শুধু তাই নয়, এরা ভিন্নমত পোষণকারী আলেমদেরকে ফ্যাসিবাদী কায়দায় জব্দ করার চেষ্টারও ত্রুটি করে না। তিনি বলেন, এদেশের মানুষ ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠা ও ইসলামী মূল্যবোধ সংরক্ষণের জন্যে যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে সর্বদা প্রস্তুত এটা সকলের জানা। তবে ইসলামী আদর্শের নামে এদেশে মওদুদীবাদ কিংবা খোমেনীবাদ প্রতিষ্ঠা করতে দেবেন না জনগণ।

প্রকৃতপক্ষে গত কয়েক মাসে জামাতীদের কার্যকলাপ ছুরিতে শান দিতে দিতে ৭১ সালের মতো ধ্বংসযজ্ঞ শুরুর আলামত বলেই মনে করার সঙ্গত কারণ রয়েছে।

সাংগঠনিক কাঠামো

জামাতের সংগঠন সম্পর্কে বাইরের লোকজনের ধারণা খুব সীমিত। একটি ফ্যাসিস্ট পার্টির মতোই জামাত অত্যন্তু সংঘবদ্ধ এবং নিবেদিত সংগঠন। সুচতুর কৌশলে, টার্গেট নির্ধারণ করে, প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে এরা সদস্য সংগ্রহের কাজে হাত দেয়।

প্রাথমিক পর্যায়ে ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে এরা ‘টার্গেটের মন জয় করার চেষ্টা করে। শুরুতেই সংগঠনের সদস্য হওয়ার প্রস্তাব দেয় না। কেননা তাতে ‘হিতে বিপরীতের সম্ভাবনা থাকে।’ একবার এ কাঠামোর ভেতর ঢুকে গেলে আর বেরুনোর উপায় নেই। দীর্ঘ চল্লিশ বছরের ইতিহাসে তাই মাত্র একবার জামাত দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে। তাও বাংলাদেশে। অপরদিকে জামাত একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে এর শাখা রয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে কেউ জামাতের পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ পায় না। আনুগত্যের একটা পর্যায় শেষে এদের বলা হয় মুত্তাফিক বা সহযোগী সদস্য। দ্বিতীয় পর্যায় হচ্ছে রোকন পূর্ণাঙ্গ সদস্য। পরবর্তী পর্যায় সদস্য, মজলিশে সুরা।

প্রায় একই অবস্থা ছাত্র সংগঠনেও। সেখানে পর্যায়গুলো হচ্ছে সমর্থক-কর্মী-সাথী-সদস্য। পূর্ণাঙ্গ সদস্য পদ লাভের পর সদস্যরা সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে সংগঠনের কাজ করেন। এজন্যে তারা সংগঠন থেকে মাসিক মাসোহারাও লাভ করেন। পাকিস্তান আমল থেকেই এ নিয়মতো চালু আছে। বর্তমানে এ নিয়ম ব্যাপকভাবে চালু রয়েছে। কেন্দ্র থেকে শুরু করে থানা পর্যায়ের কর্মীরা মাস শেষে বেতন পান। ঢাকা থেকে এই বেতন পাঠানো হয়। যারা ‘রোকন’ তাদের বেতন বেশি। জেলা পর্যায়ে এখন চারশ টাকা করে কর্মীদের বেতন দেয়া হয়। কোন কোন জেলায় এই বেতনের পরিমাণ আরো বেশি। বর্তমানের প্রেক্ষিতে জামাতে ইসলামী তরুণ ও ছাত্রদের ওপর ভর করেছে। এরা মনে করে তরুণদের দলে টানতে পারলেই ভবিষ্যতে ফায়দা লুটা যাবে।

এই লক্ষ্য সামনে নিয়েই ১৯৭৬ সালে জামাতে ইসলামী প্রতিষ্ঠিত করে ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির। শিবিরের পক্ষ থেকে বলা হয় এ সংগঠন নতুন সংগঠন, তৎকালীন ইসলামী ছাত্র সংঘের সঙ্গে এর কোনো যোগাযোগ নেই। কিন্তু বাস্তব হচ্ছে ইসলামী ছাত্র শিবির তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের উত্তরসূরি এবং বিভিন্ন নামের দুটি সংগঠনই জামাতের সহযোগী ছাত্র সংগঠন। বিভিন্ন তথ্য মেলালেই তার প্রমাণ মিলবে।

’৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিলেন আলী আহসান মুজাহিদ। ইনি বর্তমান মহানগর জামাতের সাধারণ সম্পাদক। সে সময় সংঘের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মীর কাসেম আলী, বর্তমানে রাবেতাতে ইসলামের সঙ্গে যুক্ত। এদের দুজনের নেতৃত্বেই ৭১ সালে আলবদর বাহিনী সংগঠিত হয়। আলবদর বাহিনী প্রথম সংগঠিত হয় ময়মনসিংহে কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে। ১৯৭৯ সালে কামারুজ্জামান ছিলেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি এবং বর্তমানে ঢাকা শহর জামাতের যুগ্ম সম্পাদক। আলবদর নেতা মীর কাসেম বর্তমান ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ৭৪-৭৫ সালে আত্মগোপনকারী ছাত্র সংঘের সভাপতি আবু নাসের বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশের ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূতের ব্যক্তিগত সহকারী।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর জামাতে ইসলামী বা এর সহযোগী সংগঠনগুলো বিলুপ্ত হয়ে যায়নি, শুধু আত্মগোপন করেছিলো।

বর্তমানে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি আবু তাহের ছিলেন আলবদর কমান্ডার এবং ১৯৭১ সালে ইসলামী ছাত্র সংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান এই ছাত্র নেতা আবু তাহের বর্তমানে ঢাকার মধুবাজারে বিরাট অংকের বিনিময়ে বাসা ভাড়া করে থাকেন। কিন্তু টাকা জোগায় কে? কেননা এই সংগঠনে সদস্য চাঁদা বলে কিছু নেই। টাকার উৎস সম্পর্কে জামাতীরা কেউ কথা বলতে চায় না। একটি সূত্র আভাস দিয়েছে বিদেশে লোক পাঠানোর মধ্য দিয়ে টাকা আসে। গত এক বছর ধরে গোলাম আজমের ব্যক্তিগত অনুমোদন ছাড়া কেউ মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে যাওয়ার ভিসা পর্যন্ত পায় না। এর অনেক প্রমাণ আছে। সম্প্রতি দুজন বাংলাদেশী সাংবাদিক ইসলামী সংবাদ সংস্থায় চাকরি পেয়েও এ কারণে ভিসা পাননি। জানা গেছে, ঐ দেশটি থেকে প্রতিমাসে জামাতের অনুসারীরা ১০ লাখ টাকা চাঁদা পাঠায়। এ কারণেই সম্ভব হয়েছে ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে সম্প্রতি সমাপ্ত ইসলামী ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আয়োজন করা।

জামাতীরা ৭১ সালের মতো সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলছে। জানা গেছে, এদের ট্রেনিং দেয়া হয় ঝিনাইদহ ও নাটোর এলাকায়। এবং এই ট্রেনিং পরিচালনা করেন নড়াইলের আলবদর কমান্ডার জনৈক সুলায়মান। জানা গেছে, পূর্বে এদের দুটি দল মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে অস্ত্রের ট্রেনিং গ্রহণ করে।

জামাতের কর্মীদের জন্য অন্য কোন দলে যোগদান বা অনুপ্রবেশ একেবারেই নিষিদ্ধ। এ কারণেই এদের দলের কেউ বিগত বছরগুলোতে অন্য দলে যোগ দেয়নি। রাজনৈতিকভাবে সর্বত্র কাজ করা সম্ভব নয় বলে জামাত বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন গড়ে তুলেছে। সংগঠনের পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন মুখপত্র, যেমন সোনার বাংলা, দৈনিক সংগ্রাম, ঢাকা ডাইজেস্ট প্রভৃতি। সংগঠনগুলো হচ্ছে ইসলামী এডুকেশন সোসাইটি, ইসলামী সমাজকল্যাণ সমিতি, আধুনিক প্রকাশন, মসজিদ মিশন, ফালাহ আম ট্রাস্ট, বাদশাহ ফয়সল ইনসটিটিউট ও গুলশানের মানারত প্রভৃতি। এসব সংগঠন লোক সংগ্রহের কাজে ব্যবহৃত হয়, যদিও প্রকাশ্যে এর সঙ্গে জামাতের কোনও সম্পর্ক নেই। অথচ চট্টগ্রামে যে ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদ রয়েছে তার সভাপতি হচ্ছেন মওলানা শামসুদ্দীন, যিনি চট্টগ্রাম শহর জামাতের আমীর।

জামাতের একটি প্রতিষ্ঠান আধুনিক প্রকাশনী সম্পর্কে বিচিত্রা তথ্যানুসন্ধান চালিয়েছিল। বিচিত্রা রিপোর্টার তার তথ্যানুসন্ধান রিপোর্টে বলেছেন : দশই এপ্রিল। রাত আনুমানিক ৯টা। ২৫ শিরিস দাস লেনের আধুনিক প্রকাশনীর প্রধান কার্যালয়। বিরাট প্রেস। আলো নিভে গেছে। লোহার দরজায় টোকা দিতেই বেরিয়ে এলেন একজন লোক। পরিচয় জানতে চাইলে বললেন, সিকিউরিটি গার্ড। ভেতরে ঢোকার অনুমতি চাইলে বললেন, প্রবেশ নিষেধ। তার পর জানতে চাইলেন, কেন? বললাম আমার একজন পরিচিত কম্পোজিটরের সঙ্গে কথা বলবো। তবু ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিলেন না। বরং ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, না আমি ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিতে পারবো না। সেখান থেকে ফিরে এলাম। তখন আমাকে অনুসরণ করলো তিনজন অল্প বয়স্ক যুবক। জানতে চাইলেন, কাকে খুঁজছি। বললাম, আমার এক পরিচিত কম্পোজিটরকে। কিছু সময় পরে এলাম আধুনিক প্রকাশনীর বিক্রয় কেন্দ্র, ১৩/৩ পেয়ারী দাস রোডে। তখন দোকানটি বন্ধ। আবার এলাম, শিরিস দাস লেনের প্রেসে। একজন সার্ট-প্যান্ট পরা যুবক বললেন, বারবার কাকে খুঁজছেন? বললাম তো কম্পোজিটররা কেউ নেই। তবু ভেতরে ঢুকলাম। ঢুকেই দেখতে পেলাম বাড়িটির এক কোনায় একটি টেবিলে ভাতের প্লেট সাজানো রয়েছে।

ভেতরে ঢুকতেই একজন যুবক বললেন, হাঙ্কি পাঙ্খি রাখেন। বিনীত স্বরে বললাম, আমি একটু মালিকের সঙ্গে কথা বলতে চাই। তিনি বললেন, কোন মালিক নেই। কথা বলতে পারবেন না। এ প্রতিষ্ঠান বোর্ড অব ট্রাস্টি পরিচালিত। আরেকজন বললেন, বারবার বিরক্ত করবেন না।

বাংলাবাজারে বেশ কয়েকটি লাইব্রেরীর লোকজনের সঙ্গে আলোচনা করেছি। কিন্তু কেউ বলতে পারেন না, কে মালিক? প্রতিদিনই একটি বিদেশী দূতাবাস থেকে লোকজন এসে খোঁজখবর নেন প্রেসের। এই পেয়ারী দাস রোডে যারা ধর্মীয় পুস্তকের ব্যবসা করেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তারা সকলেই হতাশা প্রকাশ করে বললেন, আমাদের পুস্তক ব্যবসা লাটে উঠবার পথে। আমতা আমতা সুরে বললেন, আধুনিক প্রকাশনী আমাদের ব্যবসা শেষ করে দিয়েছে। ধর্মের নামে রাজনীতি নিয়ে ব্যবসা শুরু করছে। আর টাকা পাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ থেকে।

পেয়ারী দাস রোডের এই বইয়ের দোকানটি চালু হয়েছে ৭৮-এর দিকে। আগে ছিলো মদিনা প্রকাশনীর। এরপর ৭৭ সালে তারা দোকানটি ভাড়া দিয়ে দেয়। বছরখানেক পরে বিক্রয় কেন্দ্র খুলে বসে আধুনিক প্রকাশনী। এ ছাড়া এই প্রকাশনীর আরেকটি বিক্রয় কেন্দ্র রয়েছে বায়তুল মোকাররমে। এর পর থেকে তারা সাড়ে তিনশরও বেশি বই প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে বিশাল আয়তনের বইও। কোন কোন পুস্তকের মুদ্রণ সংখ্যা এক লাখ পর্যন্ত। এ দেশের কোনো প্রকাশনীই একই সংস্করণে এতো বই প্রকাশ করতে পারেনি। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাদ দিলে ঢাকার সব প্রকাশনী মিলেও সাড়ে তিনশ ধর্মীয় পুস্তক প্রকাশ করতে পারেনি।

৭৮ সালের দিকে আধুনিক প্রকাশনীর বিক্রয় কেন্দ্র চালু হলেও শিরিস দাস লেনের প্রেসটি চালু হয়েছে বছরখানেক আগে। ছাপানো হচ্ছে বই। কিছুদিন প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা। আধুনিক প্রকাশনীর ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান। বিক্রয় কেন্দ্রে কাজ করছেন মোঃ ইউনুছ। আধুনিক প্রকাশনী সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, আমি কিছুই বলতে পারব না। আধুনিক প্রকাশনীর বাড়ি ও প্রেস মিলিয়ে সম্পত্তির মূল্য হবে এক কোটি টাকারও বেশি।

শিরিস দাস লেনের প্রেসে থাকছে বহু লোক। প্রতিদিন নতুন লোক আসছে। এ প্রেসের কর্মচারীরাও জানে না এর মালিক কে অথচ ঐ এলাকায় প্রেস সম্পর্কে জনশ্রুতি মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশের প্রেস। আর জামাতে ইসলামীর আন্দোলন আর কর্মধারার কার্যবিবরণী প্রকাশিত হচ্ছে এখান থেকেই। তাই আধুনিক প্রকাশনী আসলে একটি রাজনৈতিক আখড়া। খুচরা বিক্রেতারা এই প্রতিষ্ঠানের বই বিক্রি করছে শতকরা ৩০ টাকা কমিশনে। প্রকাশনীর পুস্তিকায় লেখা রয়েছে, পাইকারী ৩০ শতংশ কমিশন দেয়া হয়। কেবল ধর্মীয় পুস্তক প্রকাশিত হয়। বাংলাবাজারের কোন কোন পুস্তক ব্যবসায়ী বলেছেন, আমরা নামেমাত্র দামে শতকরা ৬০ টাকা কমিশনে আধুনিক প্রকাশনীর বই কিনেছি। তবু আমরা এই বই বিক্রি করতে উৎসাহী নই। কারণ ধর্মীয় পুস্তক ব্যবসা নিয়ে রাজনীতি চলছে।

ধর্মীয় পুস্তকের ব্যবসা নিয়ে যখন কথা বলছিলাম তখন একটি লোক আমার পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে বললেন, বহুত অইছে। এদিকে আহেন আমি আপনারে সকল তথ্য দিয়া দিমু। তিনি আমাকে একটি নির্জন গলি দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে, আমি বললাম, জনপদ প্রেসে আমার একজন লোক রয়েছে। তারা আমাকে আসতে দিতে চাইলেন না। তবু আসলাম। দৈনিক জনপদ পত্রিকার দোতলায় উঠে গেলাম। পেছনে থেকে তারাও কেটে পড়লো। আমি জানি না তারা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তাদের আচরণ আমার কাছে মনে হয়েছিল বড়ই রহস্যময়। এরা কারা? আধুনিক প্রকাশনীকে পাহারা দিচ্ছে? একজন বললেন আধুনিক প্রকাশনীর ব্যবসা মধ্যপ্রাচ্যেও রয়েছে।

একজন ধর্মীয় পুস্তকের লেখক বললেন, ১৩/৩ পেয়ারী দাস রোড, বাংলাবাজারের আধুনিক প্রকাশনী বাংলাবাজারের পুস্তক ব্যবসায়ীদের কাছে একটি বিস্ময়। কারণ এর দাপটে ধর্মীয় বইয়ের ব্যবসা আজ লাটে উঠেছে। একজন প্রভাবশালী পুস্তক ব্যবসায়ী বললেন, ৭০ সাল পর্যন্ত আমাদের বইয়ের সংখ্যা ছিল ৮৩টি। বর্তমানে রয়েছে ৯টি বই; আদূর ভবিষ্যতে বই প্রকাশের তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ ধর্মীয় বইয়ের জগতে ঢুকেছে রাজনীতি।

তাদের এখন প্রধান রাজনৈতিক আদর্শ সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী। তিনি ইসলামকে ধর্ম নয়, একটি আন্দোলন হিসেবে দেখেছেন। সেই আদর্শের বিপ্লবী যোশ আনার জন্য আধুনিক প্রকাশনী বেশ কয়েকটি বিপ্লবী বই প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ইসলাম ও সামাজিক বিল্পব, সমাজ সংস্কারে নামাজের ভূমিকা, ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ, ইসলাম ও আধুনিক অর্থনৈতিক মতবাদ, সুদ ও আধুনিক ব্যাংকিং, ইসলামের অর্থনৈতিক বণ্টন ইত্যাদি। এ ধরনের বই পড়ে বহু ধর্মপ্রাণ মুসলিম ক্ষুণœ হয়েছেন।

এ দেশে ইসলামের নামে সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর আদর্শকে প্রচার করছে আধুনিক প্রকাশনী। এই প্রকাশনী মওদুদীর ১৩ খ- তাফহীমুল কোরআন প্রকাশ করেছে। আরো ৮ খ- প্রকাশের অপেক্ষায়। প্রকাশিত এই ১৩টি বইয়ের গড় মূল্য কুড়ি টাকারও বেশি। আধুনিক প্রকাশনীর একজন কর্মচারী বলেছেন, বইগুলোর প্রতিটি খ-ের প্রথম সংস্করণ ৫০ হাজার ছাপানো হয়েছে। চল্লিশ হাজার কিনে নিয়েছে একটি বিদেশী দূতাবাস।

দিনকে দিন প্রেস সম্প্রসারিত হচ্ছে। ৮১ সালের জানুযারী মাসে বসানো হয়েছে দুটি ইস্টার টাইপ মেশিন। অথচ কর্মচারীরা নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন না। এক তারিখে বেতন পাওয়ার কথা থাকলেও তারিখ পিছিয়ে যায়। অনেক মানসিক চাপের মধ্যে কাজ করতে হয় বলে এই প্রেসের একজন কর্মকারী জানান। আরেকজন কর্মচারী দুঃখ করে বললেন, মধ্যপ্রাচ্যে যাবার জন্য এই প্রেসে কাজ নিয়েছিলাম। বহু লোককে পাঠানো হয়েছে। হচ্ছে। কিন্তু আমার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েনি। তাই দুশ্চিন্তার ভেতর সময় কাটাচ্ছি।

জামাতে ইসলামীর আরেকটি অঙ্গ সংগঠন ফালাহ আম ট্রাস্ট। এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে অনুসন্ধান চালিয়ে বিচিত্রার রিপোর্টার লিখেছেন, ‘এই ট্রাস্ট গঠন করা হয় ষাটের দশকের শেষ দিকে। কয়েকজন পাকিস্তানী ধনী তাদের বাঙালী দোসরদের নিয়ে এই ট্রাস্ট গঠন করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নতুনভাবে যে ট্রাস্ট গঠন করা হয়।

পুনরুজ্জীবনের পর এই ট্রাস্টে ছিলেন জনৈক এ, আর, লস্কর, জনৈক এইচ, এম হুমায়ন, জনৈক মৌলানা আবদুল খালেক। এই তিন জনের মধ্যে একজন মারা গেছেন, পরবর্তীতে আরো কয়েকজনকে ট্রাস্টী নিয়োগ করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমান ট্রাস্টীদের মধ্যে রয়েছেন জামাতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর আব্বাস আলী খান, মৌলবী এ কে এম ইউসুফ, দেওয়ান টেক্সটাইল মিলের মিঃ দেওয়ান এ আর লস্কর, এইচ এম হুমায়ন প্রমুখ। সব মিলিয়ে সদস্য সংখ্যা ১২। পাক আমলে ট্রাস্টীদের একজন ছিলেন চকবাজারে হেলাল ট্রেডিং-এর অবাঙালী মালিক।

জানা গেছে, এই ট্রাস্ট পঁচিশ লাখ টাকা ব্যয়ে (কারো কারো মতে ৪২ লাখ টাকা) মগবাজারে একটি বিরাট বাড়ি ক্রয় করে। অথচ বর্তমান ট্রাস্টীদের অনেকেরই সুনির্দিষ্ট আয়ের কোন পথ নেই।

অভিজ্ঞ মহল জানান, পার্টির মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের মালিকানা দখল করার জন্য এই ট্রাস্ট পুঁজি বিনিয়োগ করতে থাকে। কিন্তু অন্য অংশীদাররা ট্রাস্টের নামে শেয়ার কেনার কথা বললে তারা তা করতে রাজী হয়নি। বরং বিভিন্ন ব্যক্তির নামে শেয়ার বিক্রির জন্যে চাপ দিতে থাকেন। অংশীদাররা তাদের পুঁজির উৎস জানতে চাইলে ট্রাস্ট বা জামাত তা জানায় নি।
এই ট্রাস্ট বর্তমানে বহু সম্পত্তির মালিক। অভিযোগ আছে ট্রাস্ট বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে যাকাতের (!) অর্থ সংগ্রহ করে। বর্তমানে এই ট্রাস্টের সুরম্য অট্টালিকায় দৈনিক সংগ্রামের কার্যালয়। এই ট্রাস্টের প্রেস থেকেই সংগ্রাম ছাপা হয়। অভিযোগ আছে এই ট্রাস্টের অর্থেই পার্টি চালানো হয়।

আরো জানা গেছে ২৬টি চ্যানেলে জামাতে ইসলামী ঢাকায় বিভিন্ন সূত্র থেকে অর্থ লাভ করে। এ অর্থ দিয়ে ব্যাপকভাবে সংগঠন চালানো হয়। যার ভেতরে রয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিটি ইউনিটের পরিচালনাধীন মেস ব্যবস্থা। প্রতিটি মেসে ৫-১০ জন ছাত্র থাকেন। এ অর্থ দিয়ে কর্মীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে যানবাহনও কিনে দেয়া হয়েছে।

জামাতের আরেকটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে শতাব্দী প্রেস। এটি ছাত্রশিবিরের প্রকাশনী সংস্থা হিসেবে কাজ করে। এ ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত হয় শতাব্দী ডাইরী।

গোলাম আজম বলেন

‘নাগরিকত্ব না পেলেও আমার কোন অসুবিধা হচ্ছে না। শুধু অসুবিধা এটাই সরকার নাগরিকত্বের স্বীকৃতি না দিলে আমার পক্ষে বাইরে যাওয়া অসুবিধা হচ্ছে।’

জামাতের মুখপত্র একটি দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাতকারে অধ্যাপক গোলাম আজম এ কথা বলেছেন।

নাগরিকত্ব সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে গোলাম আজম বলেন : আমি আরো কিছু সময় অপেক্ষা করে দেখব। এখনই আমি সরকারের সঙ্গে সংঘর্ষে যেতে চাই না। কিন্তু এরও একটা সীমা আছে। আমার পক্ষে এভাবে ঘরে বসে তামাসা দেখা সম্ভব নয়।

একটি সাপ্তাহিকের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন : আমি গোঁজামিল দিয়ে কথা বলার লোক নই। যা ফ্যাক্ট তাই বলব। যা বিশ্বাস করেছি, তাই বলেছি এখনও যা বিশ্বাস তাই বলব। আমার সৎ সাহস আছে। আমি তো গোপনে কোন কাজ করিনি যে গোঁজামিল দিয়ে আগেকার ভূমিকা আড়াল করার জন্য ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলব।

স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, এরও উত্তর নাগরিকত্ব পেলে দেবো, তবুও তিনি উত্তর দিয়েছেন। প্রশ্ন করেছেন আদর্শ নিয়ে, আবার উত্তর দিয়েছেন নিজেই। ‘বাংলাদেশের আদর্শ কি সে ধারণা আমার জানা নেই।’

আলবদর, আল-শামস গঠন ও কেন নাগরিকত্ব গিয়েছিল এবং বিদেশে বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাবও এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেছেন, বলব সবই বলব, আগে নাগরিকত্ব হোক।

তথাকথিত নাগরিকত্ব পুনরুদ্ধার সংগ্রাম কমিটির চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুল জব্বার বলেন : আমরা আরো এক বছর বা দেড় বছর ধৈর্য ধরব, যদি এর মধ্যে না হয় তাহলে আমরা চূড়ান্ত কর্মসূচীতে যাব।

বুদ্ধিজীবী হত্যার নায়ক

অধ্যাপক গোলাম আজম বুদ্ধিজীবী হত্যারও অন্যতম নায়ক। ৭১ সনের সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে রাও ফরমান আলীর সঙ্গে এক বৈঠকে অধ্যাপক আজম বুদ্ধিজীবী নিধনের একটা নীল নকসা পেশ করেন। সে নীল নকসা অনুযায়ীই পরবর্তীকালে অর্থাৎ ডিসেম্বর মাসে বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। নীল নকসা প্রণয়নে আবদুল খালেক, ব্যারিস্টার কোরবান আলী, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, আব্বাস আলী খান প্রমুখ জামাত নেতারা জড়িত ছিলেন। স্বাধীনতার পর বুদ্ধিজীবী হত্যা সম্পর্কিত যে দলিলপত্র পাওয়া যায় তাতে স্পষ্ট করে নির্দেশ ছিল : পূর্ব পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখা হয়ত সম্ভব হবে না। তবে একটা কাজ করতে হবে এখানকার সব বুদ্ধিজীবী, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, ডাক্তারকে চিরতরে ‘শেষ’ করে দিতে হবে যাতে পাকিস্তান হারালেও তারা দেশ চালাতে না পারে। অধ্যাপক আজম এই নীল নকসা বাস্তবায়নের জন্য তার দলীয় ক্যাডার অর্থাৎ আলবদর ও আল-শামসকে নির্দেশ দেন। এলাকাও ভাগ করে দেয়া হয়। ১৯৭২ সনের জানুয়ারী মাসে যে কয়জন আল-বদর নেতাকে গ্রেফতার করা হয় তাদের কাছ থেকে নীল নকসার বেশ কিছু দলিলপত্র উদ্ধার করা হয়। সে দলিলের একটা অংশ নিম্নরূপ : ‘নিম্নলিখিত ব্যক্তিদেরকে ধরে এনে হত্যা করতে হবে। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। যদি কেউ আত্মগোপন করে থাকে তাহলে তার পরিবারের কাউকে ধরে এনে এমনভাবে অত্যাচার চালাতে হবে যাতে করে পলাতক ব্যক্তির সন্ধান মেলে।’ আরবীতে লেখা একটা নির্দেশ নামায় ছিল : ‘মনে রাখবেন, দুষ্কৃতিকারীরা যদি দেশে ঢুকে পড়ে তাহলে রেহাই পাবেন না। তাই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য জীবন বাজি রেখে লড়াই চালিয়ে যান।’ নভেম্বর মাসে জামাতে ইসলামীর পক্ষ থেকে এক প্রচারপত্রে বলা হয়েছিল : শত্রু আশেপাশেই রয়েছে তাই খুব সতর্কতার সঙ্গে কাজ চালাতে হবে। আল-বদরদের এক সমাবেশে জনৈক জামাত নেতা বলেন : আপনারা পাকিস্তান টিকিয়ে রাখার জন্য কেবল যুদ্ধ করছেন না, এ যুদ্ধ ইসলামের। নমরুদদের হাত থেকে মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য আমাদের আমীরের (গোলাম আজম) নির্দেশ পালন করুন।’

স্বাধীন বাংলাদেশে জামাতের অভ্যুদয়

জামাতকে হযরত সুলেমানের বোতলে পোরা দৈত্যের সঙ্গে তুলনা করা যায়। ৭১ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সামাজিক পরিবেশ ধর্ম নিয়ে রাজনীতি ব্যবসার মৃত্যু ঘটিয়েছিলো। কিন্তু রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাই মৃত জামাতের পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছে। স্বাধীনতার পর রাজনীতি ক্ষেত্রে অপরিণামদর্শিতা, এক শ্রেণীর রাজনীতিকের দুর্নীতি, প্রগতিশীল রাজনীতির ক্ষেত্রে ব্যাপক শূন্যতা ও হতাশা জামাতের পুনরুত্থানে সহায়তা করে।

৭১ সাল থেকে ৮১ সাল পর্যন্ত জামাতই একমাত্র দল যার মধ্যে বড় ধরনের ভাঙ্গন ঘটেনি। বরং সুপরিকল্পিতভাবে সমাজের-প্রশাসনের সর্বস্তরে সদস্য সংগ্রহ বা সদস্যদের স্থাপনের প্রচেষ্টা চালিয়েছে গোপনে গোপনে। আর সব দল ভেঙ্গে একাধিক হয়েছে নীতি, আদর্শ ও নেতৃত্বের প্রশ্নে। আওয়ামী লীগ ভেঙ্গে জাসদ, ডেমোক্রেটিক লীগ, জনতা পার্টি, আওয়ামী লীগ (মিজান), গণআজাদী লীগের সৃষ্টি হয়। জাসদ ভেঙ্গে আরেকটি টুকরো বাসদ হয়েছে। ভাসানী ন্যাপ ভাঙতে ভাঙতে বহু নামের মধ্যে এখন নিশ্চিহ্ন। মোজাফফর ন্যাপের অবস্থাও তাই। মণি সিংহের কমিউনিস্ট পার্টি এখন কয়েকটি পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। পিকিংপন্থী দলগুলো বহুধা বিভক্ত ও প্রায় নিশ্চিহ্ন। রাজনীতির ক্ষেত্রে এসব ঘটনা দেশের সর্বাপেক্ষা সচল এবং নির্ধারণী শক্তি ছাত্র সমাজের মধ্যেও প্রতিফলিত। বিএনপি সরকারি দল হিসেবে প্রবল হলেও একাই রাজনীতির সব নয়। মুসলিম লীগ, জমিয়তে উলামা, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি ইসলাম-পছন্দ দলগুলো বলতে গেলে নিষ্ক্রিয়। ফলে দেশের রাজনীতির অঙ্গনে ব্যাপক শূন্যতা। আর এ শূন্যতা থেকে নৈরাজ্য। এ শূন্যতা ও নৈরাজ্যই জামাতের চালিকাশক্তি, এ শক্তির ওপর নির্ভর করে জামাত নিজেকে প্রসারের প্রচেষ্টায় লিপ্ত।

এদেশের লোক ধর্মপ্রাণ ও ধর্মভীরু। এটাকেই ভিত্তি করে জামাত এগোতে চাইছে। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা অধিকাংশ লোককে অদৃষ্টবাদী করে ফেলেছে, এটা জামাতের ধারণা। দলকে বিকশিত করার এখনই সুবর্ণ সময়। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে জামাতের ৭১ সালের ভূমিকা নিয়ে। স্বাধীনতা পাওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত জামাত বাংলাদেশকে সম্বোধন করেছে ‘তথাকথিত’ বলে আর মুক্তিযোদ্ধাদের ‘দুষ্কৃতকারী’ বলে। জামাত ৮১ সালেও বলছে : ৭১ সালে যা করেছি, তা সকলের জানা, আমরা ভুল করিনি। এখানেই জামাত থেমে নেই, জামাত নেতারা বলছেন : আমাদের ৭১-এর ভূমিকা সম্পর্কে জনগণের মধ্যে কোনো রিজার্ভেশন আছে বলে মনে করি না। তাই তারা স্বাধীন বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মনেপ্রাণে মেনে নিয়েছেন বললেও জামাতের রাজনীতি সম্পর্কে সন্দেহ থেকে যায়। আসলে জামাত কি চায়? আবার পাকিস্তান না কনফেডারেশন? পাকিস্তানে ভূট্টোর পতন এবং প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের জামাতের সরাসরি প্রভাব সর্বজনবিদিত। তবে জামাত ‘ইসলামী প্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ চায়, এটা অবশ্য সরাসরি বলছে। তারপরও জামাতের মতলব পরিষ্কার নয়। কারণ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব জামাতের দর্শন মোতাবেক একটি অস্থায়ী বা অনিত্য অস্তিত্ব। তাই ভারতের মোকাবেলার নামে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশকে প্রথমে পরোক্ষ এবং পরে প্রত্যক্ষভাবে একই রাষ্ট্রের কাঠামোর ভেতরে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ৭১ সালের জামাতের রাজনীতির ভিত্তিতে বিশ্বাস করা যায়।

ধর্মের ভিত্তিতে জামাত ভারতের বিরোধিতা করে লাভবান হতে চাইছে। এদেশের লোক ভারতের স্বার্থবাদী মহলের বিরোধী, ভারতবাসীর নয়। কিন্তু জামাত এই বিরোধিতাকে সাম্প্রদায়িকতায় রূপান্তরিত করার অপপ্রয়াস নিচ্ছে। জামাতের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ আনলে নেতারা সানন্দে বলেন, ‘আল্লাহর পক্ষে বলা যদি সাম্প্রদায়িকতা হয়, তাহলে আল্লাহই সাম্প্রদায়িক।’ দেশের মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভবকে ব্যবহার করার জন্যে জামাত সক্রিয়। রংপুর ও দিনাজপুরে মসজিদের ভেতরে হঠাৎ কোরান শরীফ পোড়ানো আর কারো কাজ নয়, জামাতীদেরই কাজ এটা সকলেরই সন্দেহ।

সাম্প্রতিককালে জামাত তার অঘোষিত আমীর ও পাকিস্তানের নাগরিক অধ্যাপক গোলাম আজমের নাগিরকত্ব পুনর্বাহালের জন্যে জোর আন্দোলন করছে। গত ১৬ মার্চ নাগরিকত্ব পুনরুদ্ধার কমিটি প্রকাশ্যে জনসভায় ঘোষণা করেছে, আর আবেদন নিবেদন নয়, এবার থেকে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম। এ জন্যে তারা এক পর্যায়ে সরকারের বিরুদ্ধেও ‘স্বৈরাচারী’ বলে অভিযোগ এনেছে। দলের বর্তমান রাজনৈতিক তৎপরতা দেখে মনে হয় জামাত তার আন্দোলন প্রবল করবে এবং ‘ইসলামী শাসনের’ নামে দেশে অরাজকতা-নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে। এসব আলামত ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করা গেছে। বেশ কয়েকটি প্রদর্শনীস্থল জামাতীরা পুড়িয়ে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত কিছু ব্যক্তি রহস্যজনকভাবে নিহত হয়েছেন।

মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর জামাতীদের আক্রোশ কেন?

মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলায় সারাদেশ এখন প্রতিবাদে সোচ্চার। স্বাধীনতা সূর্য যারা আনল, তাদের ওপর জামাতীদের হামলা আকস্মিক ঘটনা নয়, সুপরিকল্পিত। মুক্তিযোদ্ধাদের ওপরই জামাতীদের সবচেয়ে বেশি আক্রোশ। এই ‘দুষ্কৃতকারীরাই’ ৭১ সালে পাকসেনা ও জামাতীদের জুলুমের প্রতিবাদ করেছে সশস্ত্র ভাষায়। মুক্তিযোদ্ধা না থাকলে দেশ স্বাধীন হতো না। পাকিস্তানও ভাঙত না। মুক্তিদের জন্যেই ৭১-এ তথাকথিত উপ-নির্বাচনে জয়ী হয়েও বেতমারা হাত কাটার শাসন কায়েম করতে পারলো না। শুধু তাই নয় মুক্তিযোদ্ধারাই স্বাধীন বাংলাদেশে জামাতের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর। প্রকাশ্য প্রতিবাদ তারাই করেছে। জামাতকে এখনো তারাই বাধা দিচ্ছে আন্তরিকভাবে। তাই মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকারী ৭১-এর আল-বদররা আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের নিশ্চিহ্ন করার ওপরই নির্ভর করছে জামাতের সফলতা। প্রথমে তারা ৭২ থেকে ৭৫ সাল পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নামে সুপরিকল্পিতাবে দুর্নাম রটানোর অপপ্রয়াস চালিয়েছে। ধীরে ধীরে সে ফাঁকে সংঘবদ্ধ হয়ে জামাতীরা মুক্তিযোদ্ধাদের একে একে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা নিয়েছে। বর্তমান সময় তাদের জন্যে সুযোগের দরজাও খুলে দিয়েছে। কারণ বিভিন্ন দল-উপদলে মুক্তিযোদ্ধারা বিভক্ত এবং আত্মসংঘাতে লিপ্ত। মুক্তিযোদ্ধাদের গায়ে হাত দিচ্ছেন একদিকে, অপরদিকে মুখে জামাত নেতারা বলছেন, জামাতের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো বিরোধ নেই। ৭১ সালে নির্বিচারে তারা যাদেরকে হত্যা করেছেন, তারা এখন জামাতীদের কথায় মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের সম্পদ। আমাদের তাদের সংরক্ষণ করা উচিত। সেসঙ্গে তারা আবার বলছেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের কাজ ফুরিয়ে গেছে। তারা পাল্টা প্রশ্ন করেন ‘দশ বছর পরও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ টিকিয়ে রাখার কি দরকার? শুধু তাই নয় জামাতীরা মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধা প্রশ্ন তুলে দেশকে দ্বিধাবিভক্ত করতে চান। স্বাধীনতাবিরোধীদের সমালোচনা করায় এমনকি মুক্তিযোদ্ধা প্রেসিডেন্ট জিয়ার বিরুদ্ধে ‘জাতিকে বিভেদের দিকে ঠেলে দেয়ার’ অভিযোগ করেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা জানেন যে, জামাতীরা দেশে ‘গৃহযুদ্ধের’ একটা পরিবেশ সৃষ্টি করে দেশকে আবার ‘পাকিস্তান’ বানানোর ষড়যন্ত্র করছে। এখানেই জামাতীদের ক্রোধ। তাদের ইচ্ছে ও স্বপ্নের সামনে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা মুক্তিযোদ্ধারা।

বিশেষ দ্রষ্টব্য : ১৯৮১ সালের এপ্রিলে অধ্যাপক গোলাম আজম বিচিত্রা প্রতিনিধিদের বলেছিলেন নাগরিকত্ব পাওয়ার আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে তার কথা বলা চলে না, উচিতও নয়। আর ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে নাগরিক হওয়ার আগেই তিনি জামাতের আমির পদটি গ্রহণ করেন। তিনি তার নিজের কথাও রাখেন নি। নয় কি?

গোলাম আজম কথা বলবেন না

অধ্যাপক গোলাম আজমের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হয় ১২ এপ্রিল। বিকেলে। তার মগবাজারের বাসায়। একতলা ছোট দালানে তার অফিস। অফিসের সামনে একটি ছোট দোকান। ভবনটির তিনটি কামরা আমরা দেখতে পেয়েছি। ঢুকতেই বসার ঘর। ঘরে কয়েকজন দর্শনার্থী। একটি টেলিফোন, সংবাদপত্র, পুস্তিকা ও জামাতে ইসলামীর সাম্প্রতিক সাংবাদিক সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যের কপি টিপয়ে টেবিলে ছড়ানো। দেয়ালে টাঙানো দর্শনার্থীদের জন্য নির্দেশ : অধ্যাপক সাহেবের সঙ্গে বিশেষ কথা থাকলে সময় নিয়ে (অ্যাপয়েন্টমেন্ট) যান। অন্য বিষয়ে আলাপ করতে চাইলে আছর বা মাগরেবের পর মসজিদে আসুন। ব্যক্তিগত কাজে টেলিফোন ব্যবহার করবেন না।

বসার ঘরের পাশেই অধ্যাপক আজমের ব্যক্তিগত সহকারীর কক্ষ। গিয়ে পরিচয় দিতেই তিনি বললেন, ‘টেলিফোন করে এলে ভাল করতেন। দেখা যাক কি করা যায়।’ বাইরে অপেক্ষা করতে বলে তিনি কার্ড নিয়ে ভেতরে গেলেন। প্রায় ১৫ মিনিট পর সাক্ষাতের জন্য ডাকলেন। সহকারীর পরের কক্ষে অধ্যাপক আজম বসেন। ঢুকতেই উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে পরিচিত হলেন। একটি টেবিলে মুখোমুখি বসলাম। ব্যক্তিগত সহকারীও উপস্থিত থাকলেন। একহারা চেহারা। সযত্নে চর্চিত কাঁচা-পাকা শ্মশ্রু। চেয়ার, দুটো টেবিল, বইয়ের তাক। সাজানো-গোছানো ঘর।

তিনি সাক্ষাৎকার দিতে অস্বীকার করে বললেন : আমি এখন সাক্ষাৎকার দেব না। নাগরিকত্ব পাবার পর সব বক্তব্য নিয়ে আমি জনগণের সামনে যাব। তার আগে আমি কিছুই বলব না।

বিচিত্রা : সম্প্রতি আপনাকে নিয়ে যেভাবে আলোচনা হচ্ছে তাতে আপনি সাক্ষাৎকার দিতে পারেন।
গোলাম আজম : সাক্ষাৎকার আমি দেব। সাক্ষাৎকার আমাকে দিতেই হবে। কারণ জনগণের কাছে আমার বক্তব্য নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু এখন নয়। নাগরিকত্ব না পেলে সাংবাদিকদের সঙ্গে আমার কথা বলা চলে না, উচিতও নয়।
বিঃ আপনি বলতে পারেন। ধরুন যুক্তরাষ্ট্রের একজন নাগরিক যদি বাংলাদেশ ভ্রমণে এসে সমালোচনার সম্মুখীন হন তবে তার নিশ্চয়ই জবাব দেওয়ার থাকে। আপনি বাংলাদেশের নাগরিক না হয়ে যে কোন দেশের নাগরিক হোন না কেন সাংবাদিকদের সঙ্গে আপনি কথা বলতে পারেন এবং আপনার বলা উচিত।

গোঃ আঃ আমি কিছুদিন আগে রোববারের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম সব প্রশ্নের জবাব আমার নাগরিকত্ব পাওয়ার পর দেব। দেখুন কিছুদিন আগে রংপুরে আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাই। একটি দৈনিকের প্রতিনিধি সেখানে আমার সাক্ষাৎকার চান। তাকেও আমি একই কথা বলেছিলাম। শুধু তাকে কথায় কথায় বললাম “যে সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাকে দেশে ফিরিয়ে এনেছে সেই আমাকে দেশ থেকে বের করে দিতে পারে।” কিন্তু সংবাদ আল্লাহ শব্দটি বাদ দিয়ে ছাপল “যে আমাকে দেশে এনেছে সেই আমাকে দেশছাড়া করতে পারে।” তারপর সেদিন আমাদের নেতারা বললেন এক কথা আর সংবাদ তা কেমন করে ছাপল। রোববার ইত্তেফাক গ্রুপের কাগজ। অথচ সেই খবর ইত্তেফাক থেকে ‘কোট’ না করে করল সংবাদ থেকে। যা হোক, আমি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলব না।

বিচিত্রা : আমরা আপনার বক্তব্য বিকৃত করব না। আপনার পক্ষে তো ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন নেতারা বিবৃতিও দিয়েছেন। আপনি চাইলে আপনার সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে নিতে পারি। প্রেসে দেবার আগে আপনাকে দেখাতে পারি এবং আপনি চাইলে ফেলতে পারি।

গোঃ আঃ (নিরুত্তর)।

ব্যক্তিগত সহকারী : কিন্তু নাগরিকত্ব পুনরুদ্ধার কমিটির নিষেধ আছে।

গোঃ আঃ তাদের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই। সেদিন এসে বলল বলুন তো এই প্রচ্ছদটি কেমন হল? আমি বলে দিয়েছি এগুলো আমাকে দেখাবেন না। এগুলো কথা নয়। আমি এখন সাক্ষাৎকার দেব না।

এই পর্যায়ে তিনি সাক্ষাৎকার না দিয়ে সাধারণ আলোচনার রাজী হন। এবং কিছুদিন পর সাক্ষাৎকার দেবেন বলে উল্লেখ করেন।

বিঃ আপনার পার্টি ও তার অঙ্গ সংগঠনের বিষয়ে আমাদের জানার ছিল।

গোঃ আঃ পার্টির বিষয়ে পার্টির নেতাদের সঙ্গে আলাপ করবেন।

বিঃ কিন্তু কার্যত আপনিই তো পার্টির প্রধান।

এর কোন জবাব না দিয়ে গোলাম আজম মাগরেবের নামাজ পড়ার জন্যে প্রস্থান করেন।

অসমর্থিত খবরে জানা গেছে, কোন একটি দেশের একজন প্রতিনিধি বাংলাদেশে একটি সেমিনারে যোগদানের উদ্দেশে ঢাকায় এসে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনাকালে তিনি নাকি গোলাম আজমের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেবার অনুরোধ জানান। এর আগে গোলাম আজম নাকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে তার নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেবার ব্যাপারে বারবার অনুরোধ জানিয়েও কোনো ফল পাননি।

মন্তব্যসমূহ
বই পড়তে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি' এ্যাপটি ব্যবহার করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button