একাত্তরে বাগেরহাট
স্বরোচিষ সরকার
সাহিত্য বিলাস
বাগেরহাট শহরের একাধিক স্থান এবং শহরের উপকণ্ঠে বেশ কয়েকটি জায়গায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা গণহত্যার ঘটনা ঘটায়। বাগেরহাটে গণহত্যার পথম ঘটনা ঘটে ২৪শে এপ্রিল। এদিন তারা মির্জাপুর, কাড়াপাড়া, বাদেকাড়াপাড়া, ফুলতলা, দশানী ও বাগেরহাট শহরে অর্ধশতাধিক সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। ১৯৭১ইং মে তারিখে বাগেরহাট আমলাপাড়ায় অবস্থিত ওয়াপদা রেস্ট হাউসে পাকবাহিনীর ক্যাম্প এবং বাগেরহাট ডাকবাংলাতে রাজাকার বাহিনীর ক্যাম্প স্থাপিত হওয়ার পর বাগেরহাট ডাকবাংলার ঘাটকে প্রধান বধ্যভূমি হিসেবে বেছে নেয়া হয়। ১৭ই ডিসেম্বরের পূর্ব পর্যন্ত এখানে অসংখ্য লোককে এনে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে।
বাগেরহাট শহরে আরো কয়েকটি বধ্যভূমির কথা জানা যায়। একটি মোজাম ডাক্তারের চেম্বারের পেছনে অবস্থিত নদীর ঘাট, একটি বাগেরহাট বাজারে অবস্থিত রসিক প্রামাণিকের বিল্ডিং, এবং একটি পাকবাহিনীর ক্যাম্প ওয়াপদা রেস্ট হাউস চত্বর। সাধারণ রাজাকাররা ডাকবাংলোয় থাকলেও রসিক প্রামাণিকের বিল্ডিংটিকে রজ্জব আলী ফকির তাঁর নিজস্ব অফিস হিসেবে ব্যবহার করতেন এবং সেখানে তিনি অবস্থান করতেন। স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের তিনি এখানে ডেকে এনে হত্যা করতেন। এই বিল্ডিংয়ের নীচে ছিল ব্যবসায়ী বলরাম সাহার দোকান। ৬ই মে সকালে বলরাম সাহা এবং তার তিন জন সঙ্গীকে রজ্জর আলী ফকির নিজে গুলি করে হত্যা করার পর মৃতদেহগুলোকে দড়াটানা নদীতে ফেলে দিয়েছিলেন। অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডে কোনো প্রকার গুলি খরচ করা হতো না, ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে মারা হতো। এ কাজের জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল রাজাকার বাহিনীর একাধিক ব্যক্তিকে, যাদের মধ্যে আকিজউদ্দিন এবং মজিদ কসাই ছিল অন্যতম। বিশেষভাবে আকিজ উদ্দিনের নৃশংসতা এতোটা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, স্বাধীনতা উত্তরকালে তা অনেকটা মিথে পরিণত হয়ে গেছে। আকিজ উদ্দিনের বয়স, শারীরিক বৈশিষ্ট্য এবং হত্যাকাণ্ডের সময়ে তাঁর আচরণ সম্পর্কে কবি ও কথাসাহিত্যিক আবুবকর সিদ্দিক যা লিখেছেন, এ প্রসঙ্গে তা উদ্ধৃতিযোগ্য:
আকিজউদ্দিন ছিল আশি বছরের বৃদ্ধ। লম্বা ট্যাঙা শাদা চুলদাড়ি সাদা সুন্নতি পাঞ্জাবি সাদা লুঙ্গি সাদা টুপি। শীর্ণ শ্যামলা। তাকে নিয়ে এত বাক্যব্যয়ের কারণ আছে। এই দীর্ঘদেহী বৃদ্ধের উবু হতে গেলে কোমরে কষ্ট হত। তাই সে ভিক্টিমদের রিকোয়েস্ট করত নিজে থেকে মাটিতে শুয়ে পড়ে গলা পাতিয়ে দিতে। সহযোগী রাজাকাররা তাকে এ কাজে সাহায্য করত। তারপর সে রামদা শানাতে শানাতে হাসতে হাসতে বলত, ‘‘বাবারে! নড়িসনে! গলাডা বাড়ায়ে দে! তোরও কষ্ট হবে নানে, আমারো কষ্ট হবে নানে।” এবং সে সারি পাতা গলাগুলোর উপর দিয়ে রামদা চালিয়ে যেত। আকীজ উদ্দিনের নাম হয়ে গিয়েছিল রামদা স্পেশালিস্ট।”
অত্যন্ত নির্বিকারচিত্তে মানুষ খুন করতে পারতো বলে বাগেরহাটের বধ্যভূমি ছাড়াও রজ্জব আলী ফকির তাঁর বাহিনী নিয়ে যখন যে গ্রামে গিয়ে গণহত্যার ঘটনা ঘটাতেন, সেসব জায়গায় আকিজউদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। এছাড়া রাজাকার বাহিনীর অন্যতম কমান্ডার সিরাজ মাস্টারও ছিলেন একজন দুর্ধর্ষ কসাই। ভারতের ‘দালাল’ নিধনের ব্যাপরে তাঁর উন্মাদনা এতো বেশি ছিল যে, হতভাগ্যদের গলাকাটা শরীরের রক্ত তিনি তাঁর বৃহদাকার ছোরার ডাগার পরতে পরতে শুকিয়ে রাখতে পছন্দ করতেন।
বাগেরহাটে রাজাকার বাহিনীর এই সদস্যরা দিনের পর দিন বাগেরহাটের ডাকবাংলোয়, রসিক প্রামাণিকের বিল্ডিংয়ে, এবং মোজাম ডাক্তারের চেম্বারের নদীর ঘাটে সাধারণ মানুষকে ধরে এনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জবাই করে হত্যা করেছে।
মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে মোজাম ডাক্তারের চেম্বারের ঘাটে সংগটিত একটি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তথ্য দিয়েছেন চরগ্রাম গ্রামের অধিবাসী আক্কাস আলী হালদার। ঘটনার দিন বাগেরহাটের ভৈরব নদীর অপর তীরের চরগ্রামে খোকা মালোদের বাড়িতে এসে আশ্রয় নিয়েছিল বাগেরহাট মালোপাড়ার পলাশ ও রতন। অন্য এলাকার লোকদের বাড়িতে আশ্রয় দেয়ার অপরাধে রাজাকার বাহিনী খোকা মালোকে গুলি করে হত্যা করে এবং খোকা মালোর ছেলে পীযূষকে সহ বাগেরহাট মালোপাড়ার পলাশ ও রতনকে বাগেরহাটে ধরে নিয়ে আসে। তারপর মোজাম ডাক্তারের চেম্বারের ঘাটে এই তিন জনকে জবাই করে হত্যা করা হয়।
নওমুসলিম তাহমিনা বেগম ওরফে দীপালি গুহ (বসু) একদিন একটি সুপারিশ নিয়ে রজ্জর আলীর হেডকোয়ার্টার রসিক প্রামাণিকের বিল্ডিংয়ে গিয়েছিলেন, কিছুক্ষণ আগে সেখানে একজনকে হত্যা করা হয়েছিল, যার শরীরের ‘চাপ চাপ’ রক্ত তিনি সেখানে দেখতে পেয়েছিলেন। এছাড়া একদিন তিনি দড়াটানা নদীর ঘাটে দড়িবাঁধা অবস্থায় আরো চার-পাঁচটি গলাকাটা লাশ দেখতে পান।ওয়াপদা রেস্ট হাউসে অবস্থিত পাকবাহিনীর ক্যাম্প চত্বরে গণহত্যা খুব বেশি হয়েছিল, তা মনে হয় না। স্পট থেকে মানুষ টেনে এনে কোনো একটা নির্দিষ্ট স্থানে খুন করার হাঙ্গামা অনেক। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাকবাহিনী তাই স্পটেই কাজ সেরে নিতো। পাকবাহিনী ২৪ শে এপ্রিল তারা মির্জাপুর-কাড়াপাড়া হয়ে বাগেরহাট আসার পথে আসতে আসতে এভাবে প্রায় অর্ধশত মানুষকে হত্যা করেছিল—তাদের ১০ই মে তারিখের অভিযানেও বেশ কয়েকজন বাগেরহাটবাসীর জীবনাবসান ঘটে।
বর্তমান বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার একটি বাগেরহাট। ১৯৭১ সালে এটি ছিলাে খুলনা জেলার মহকুমা। তখন এই অঞ্চলের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ও বিপক্ষে কীভাবে
সংগঠিত হয়েছিলাে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দেশীয় দোসররা পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার নামে কীভাবে তা ও নৃশংসতার চরম নজির সৃষ্টি করেছিলাে, সাধারণ মানুষের জীবন কতােটা অনিশ্চিত, দুর্বিষহ ও বিপন্ন হয়ে উঠেছিলাে, দেশত্যাগ ও কৃত্রিম পন্থা অবলম্বন করে মানুষ কীভাবে বেঁচে থাকার প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছিলাে,
সর্বোপরি, হানাদার বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে গ্রামের অত্যন্ত সাধারণ মানুষও
কীভাবে দেশপ্রেম ও বীরত্বের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলে গ্রন্থটিতে তা
উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে।
একই লক্ষ্যে এর অধ্যায়গুলোতে পর্যায়ক্রমে বর্ণিত হয়েছে বাগেরহাট জেলার সাধারণ পরিচিতি; মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক পর্যায়ে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়া; পাকবাহিনী ও তাদের সহযোগীদের আক্রমণ, নির্যাতন ও গণহত্যা; মুক্তিযোদ্ধার প্রতিরোধ, যুদ্ধ ও বিজয় প্রসঙ্গ। গ্রন্থের কয়েকটি পরিশিষ্টে এই অঞ্চলের শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকিস্তান বাহিনীর সহযােগীদের তালিকা অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া গ্রন্থের নির্ঘণ্টে বিন্যস্ত নাম বিশেষ্যের সূত্র ধরে পাঠক অনায়াসেই তার কাঙ্খিত তথ্যের সন্ধান লাভ করতে পারবেন।