বই-দলিলপত্র-প্রবন্ধসকল কনটেন্ট
Trending

গোলাম আযম ভাষাসৈনিক ছিল না – সাব্বির হোসাইন

বই পড়তে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি' এ্যাপটি ব্যবহার করুন।

গোলাম আযম ভাষাসৈনিক ছিল না

সাব্বির হোসাইন

আগস্ট ১১, ২০১৫

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর একাত্তরের পরাজিত শক্তিরা স্বাধীন বাংলাদেশে পুর্নবাসিত হয়।

সে প্রক্রিয়ায় একাত্তরের বাঙালি নিপীড়নের অন্যতম রূপকার গোলাম আযমকে পুর্নবাসিত করার উদ্দেশ্যে কিছু প্রোপোগান্ডা সৃষ্টি করা হয়; তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো- গোলাম আযম একজন ভাষা সৈনিক।

কিন্তু ইতিহাস, তথ্য উপাত্ত ও প্রমাণ ভিন্ন কথা বলে; সত্য অনুসন্ধানে সেদিকে আলোকপাত করছি-

২৭ নভেম্বর, ১৯৪৮; পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবেশে ভাষণ দেয়। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা একটি মানপত্র পাঠ করে। ওই মানপত্রে অন্যান্য বিষয়ের সাথে একটি অংশে বাংলা ভাষা নিয়ে দাবি জানানো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান চৌধুরী মানপত্রটি লিখেছিলেন।

মানপত্রটি ডাকসু কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের* ভাইস প্রেসিডেন্ট অরবিন্দ বোসের পাঠ করার কথা ছিল। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি চরম সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত বিদ্বেষ-অবিশ্বাসের কারনে মানপত্রটি মুসলমান ছাত্র হিসেবে ডাকসু কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের* অনির্বাচিত জেনারেল সেক্রেটারী গোলাম আযমকে পড়তে দেয়া হয়। (সূত্র: ‘জীবনে যা দেখলাম’ – গোলাম আযম)

* বর্তমান ডাকসু (DUCSU – Dhaka University Central Student’s Union) নামে পরিচিত ছাত্র প্রতিষ্ঠানটিকে সেকালে Dhaka University Student’s Union বলা হতো।

এটা সুস্পষ্ট যে, পরিস্থিতির কারনে গোলাম আযম সেই মানপত্র পাঠ করেছিল।

এখানে দুটো পয়েন্ট চিহ্নিত করা যায়-

০১. বাংলা ভাষা আন্দোলনে তার সম্পৃক্ততা কতটুকু?

০২. মানপত্রে বাংলা ভাষা নিয়ে যে দাবি জানানো হয়েছিল, তা কি গোলাম আযম সমর্থন করতো?

প্রথম প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করে পাওয়া যায়:

বাংলা ভাষা আন্দোলনে গোলাম আযমের কোন সম্পৃক্ততা নেই। কারন, সেদিন মানপত্রটি বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে পড়তে হয়েছিল। মানপত্রে বাংলা ভাষার দাবিটি সে নিজেই সমর্থন করতো না (এর প্রমাণ দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে দেয়া হবে)।

একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, বাংলা ভাষা আন্দোলনের কোথাও তার উপস্থিতি ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না- ভাষা সংগ্রামের কোন স্তরের আন্দোলনে তার উপস্থিতি নেই; ভাষা আন্দোলনের জন্য গঠিত কোন কমিটিতে সে ছিল না; ভাষা সংগ্রামের কোন সভা বা মিছিলে তার উপস্থিতি নেই; সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচীতে প্রথম সারির সব ভাষা আন্দোলনকারীদের উপস্থিতি থাকলেও, সেখানে তার উপস্থিতি নেই; যেখানে ভাষা আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারী গ্রেফতার হওয়া ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হওয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা, সেখানে সে একবারো গ্রেফতার বা বহিষ্কার হয়নি; ২১ ফেব্রুয়ারি ও ১৪৪ ধারা ভঙ্গের আন্দোলনের কোন অংশে সে উপস্থিত ছিল না।

তাই, এটি স্পষ্ট, বাংলা ভাষা আন্দোলনে গোলাম আযমের কোন সম্পৃক্ততা ছিল না।

দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করে দেখা যায়:

মানপত্রে বাংলা ভাষা নিয়ে যে দাবি জানানো হয়েছিল, তা গোলাম আযম সমর্থন করতো না।
এর প্রমাণ হিসেবে বেশ কয়েকটি দলিল উপস্থাপন করা যাক:

০১.
১৯৭০ সালের ২০ জুন দৈনিক আজাদ পত্রিকার পঞ্চম পাতায় একটি প্রতিবেদন দেখা যায়, গোলাম আযম নিজেই বলছে যে, বাংলা ভাষা আন্দোলন একটি ভুল ছিল।

(পত্রিকার কাটিংটি পড়তে ছবিতে ক্লিক করুন)

গোলাম আযমের বক্তব্য ছিল-

মুছলমানদের অধিকাংশ তম্মুদিন ও ধর্মীয় জ্ঞানের ভাণ্ডার উর্দু ভাষায় সংরক্ষিত রহিয়াছে।জাতীয় ভাষার প্রশ্ন উঠার পর পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলনকারীদের মধ্যে তিনিও একজন ছিলেন কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিকোন থেকে তাহা মোটেও সঠিক কাজ হয়নি।কারণ উর্দু ভাষা ব্যাপকভাবে প্রচলিত এবং পাক ভারতের সকল প্রদেশের মুছলমানরা উহা বুঝিতে পারে।উর্দু হচ্ছে এমন একটা ভাষা যার মাধ্যমে ইসলামী শিক্ষার উপযুক্ত প্রচার ও প্রসার সম্ভব।উর্দু পাক-ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের সাধারণ ভাষা এবং এতে তাদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সম্পদ সংরক্ষিত রয়েছে।

০২.

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সামরিক বাহিনী শহীদ মিনার গুঁড়িয়ে দেয়।

এই গর্হিত কাজকে সমর্থন করে দেয়া গোলাম আযমের একটি বিবৃতি ১৯৭১ সালের ১৬ জুলাই জামায়াতের মুখপাত্র দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় বের হয়।

[ সূত্র: মুক্তিযুদ্ধে দৈনিক সংগ্রামের ভূমিকা – আলী আকবর টাবী ]

০৩.

গোলাম আযম তার আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘জীবনে যা দেখলামে’ নিজ জবানীতেই উর্দুর সাফাই গাইছে-

উপমহাদেশে যারা ইসলামের কর্মসূচী নিয়ে চর্চা করেন, তাদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমই হলো উর্দু। শ্রীলঙ্কা, নেপাল, আফগানিস্তান ও মায়ানমারসহ গোটা উপমহাদেশের মুসলমানদের কমন ভাষা একমাত্র উর্দুই। উচ্চশিক্ষিতদের জন্য ইংরেজি কমন ভাষা হলেও সকলের জন্য উর্দুর কোনো বিকল্প নেই। মুসলমানদের জন্য বিভিন্ন কারণে এ ভাষায়ই সবচেয়ে সহজে ভাবের আদান-প্রদান সম্ভব। বিশেষ করে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের মুসলমানদের বিরাট জনশক্তি ঐসব দেশে রয়েছে। তাদের মধ্যে যারা ইসলামী কর্মকান্ডে জড়িত, তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। উপমহাদেশের কোন দেশ থেকে কোন ইসলামী ব্যক্তিত্ব আসলে তারা যৌথ সমাবেশের আয়োজন করে থাকেন। তাদের পারস্পরিক যোগাযোগ ও মতবিনিময়ের মাধ্যম প্রধানত উর্দু ভাষা। তাই বাংলাদেশীরাও উর্দু মোটামুটি বুঝে এবং কিছু কিছু বলতেও পারে।

সুতরাং, এটি স্পষ্ট, মানপত্রে বাংলা ভাষা নিয়ে যে দাবি জানানো হয়েছিল, তা গোলাম আযম সমর্থন করতো না।

অর্থাৎ, এটি শ্বাশ্বত সত্য, গোলাম আযম ভাষা সৈনিক ছিল না।

মন্তব্যসমূহ
বই পড়তে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি' এ্যাপটি ব্যবহার করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button