অডিও-ভিডিওবই-দলিলপত্র-প্রবন্ধ
Trending

ফকির আলমগীরের মুক্তিযুদ্ধ

বই পড়তে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি' এ্যাপটি ব্যবহার করুন।

জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ফকির আলমগীর (১৯৫০-২০২১) প্রয়াণের মধ্য দিয়ে বাস্তব জগত্ থেকে বিলীন হলেন। তার তিরোধান অপ্রত্যাশিত। তিনি ছিলেন বাঙালির অন্তরের জাগ্রত হাসি, কঠিন সময়ে টিকে থাকার প্রেরণা। যত দিন তার সঙ্গে দেখা হয়েছে, বইমেলা কিংবা বাংলা একাডেমির আঙিনায়, সব সময়ই তার হাসি মুখের চাহনি দেখেছি। জগন্নাথ কলেজে পড়েছিলেন বলে আপন ভাবতেন জগন্নাথের কাউকে দেখলে। গণসংগীতের যে ধারাটি ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর মাধ্যমে সারা দেশের মানুষকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সচেতন করে তুলেছিল, তার প্রতিষ্ঠাতা ও নেতৃত্বে ছিলেন ফকির আলমগীর। তিনি সাধারণ মানুষের কাছের ছিলেন। কারণ, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জীবনকে দেখার দৃষ্টি ছিল তার সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে নিবেদিত। তিনি লেখক ছিলেন—তাই শিল্প-সাহিত্যের গুণগ্রাহী হিসেবে তার নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা সবার জানা ছিল। সব বিবাদ-বিদ্বেষের ওপরে থেকে বন্ধুত্বের আলিঙ্গনে নিজেকে উজাড় করে দিতে পেরেছিলেন বলেই মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছিলেন। একুশে পদকপ্রাপ্ত (১৯৯৯) এই গুণীর প্রস্থানে বাংলার আকাশ আজ বিষণ্নতায় মলিন। তিনি ২০১৩ সালে ফেলোশিপ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে ২০১৫ সালে সংগীতে মহাসম্মান পদক, ২০১৮ সালে ঢালিউড অ্যাওয়ার্ড পেলেও ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ না পাওয়ার আক্ষেপ ছিল তার মনে। ২০১৯ সালে এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন শব্দসৈনিক। গত ৫০ বছরে গণসংগীতকে আমি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে দিয়েছি। বন্যার মতো জাতীয় দুর্যোগ, মহামারি, রোহিঙ্গা ইস্যুসহ সমসাময়িক সামাজিক দায়বদ্ধতা ছাড়াও আমি শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে গান গেয়েছি। লেলিন থেকে লালন, মার্কস থেকে মাইজভাণ্ডারী ৫০ বছর ধরে গানের এই যে তাল ধরে রেখেছি তার জন্য আমি স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়ার দাবি রাখতে পারি।’

২০২০ সালে শুরু হওয়ার পর এ যাবত্ অবধি করোনা মহামারি আমাদের কাছের অনেককে কেড়ে নিয়েছে। সেই সারণিতে ফকির আলমগীরও যুক্ত হলেন। ২৩ জুলাই (২০২১) ৭১ বছর বয়সে মৃত্যুকে অসহায়ভাবে বরণ করেন তিনি। ফকির আলমগীর ১৯৫০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানার কালামৃধা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মো. হাচেন উদ্দিন ফকির, মা বেগম হাবিবুন্নেছা। তিনি কালামৃধা গোবিন্দ হাই স্কুল থেকে ১৯৬৬ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। জগন্নাথ কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় এমএ পাশ করেন। ১৯৬৬ সালে ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের সদস্য হিসেবে ছাত্র রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী ও গণশিল্পী গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে ষাটের দশকে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সংগীত জগতে প্রবেশ করেন। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তিনি একজন শব্দসৈনিক হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেন।

এ পর্যন্ত এক হাজারের বেশি গান করেছেন এই গুণী শিল্পী এবং ৩০টি অ্যালবাম করেছেন। আশির দশকে দেবু চৌধুরীর প্রযোজনায় বৈশাখী প্রোডাকশন থেকে ‘আউল বাউল ফকির’ শিরোনামে তার প্রথম অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। এরপর ডন মিউজিক থেকে সখিনার সিরিজ প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে তিনটি সখিনা ও চারটি পার্বতীপুর স্টেশনে। কনকর্ড থেকে প্রকাশিত হয় শবমেহের, উরিরচরের সখিনা, মধুমিতা মুভিজ থেকে প্রকাশিত হয় মুক্তি, টোকাই, সরগম থেকে সখিনার বিলাপ, শিখা অনির্বাণ অ্যালবাম। সেখানে জন হেনরি, ম্যান্ডেলার মতো গানগুলো আছে। কিছু গান আমাদের কাছে যেমন তেমনি তার কাছেও প্রিয় ছিল। যেমন—মায়ের এক ধার দুধের দাম ও সখিনা, মোর সখিনার কপালের টিপ, দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কালো কালো মানুষের দেশে, বনমালি তুমি। এসব গান মানুষের মুখে মুখে শুনতে পাওয়া যায়। অবশ্য ‘ও সখিনা গেছোস কিনা ভুইলা আমারে’, ‘নাম তার ছিল জন হেনরি’, ‘মায়ের একধার দুধের দাম’ প্রভৃতি বহুল পরিচিত গান এবং মুক্তিযুদ্ধ ও গণসংগীত নিয়ে তার লিখিত বই পাঠকমহলে প্রশংসিত হয়েছে। মৃত্যুর আগেও অবসরে তিনি লিখে গেছেন। শেষ পর্যন্ত তার ১৩টি বই প্রকাশিত হয়েছে। ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজয়ের গান’ এবং ‘গণসংগীতের অতীত ও বর্তমান’ ছাড়াও ২০১৩ সালে প্রকাশিত—অমর কথা, যারা আছে হূদয় পটে এবং স্মৃতি আলাপনে মুক্তিযুদ্ধ তার রচিত অন্যতম গ্রন্থ।

ফকির আলমগীর বাল্যকাল থেকেই সংগীতের প্রতি আকৃষ্ট হন। হিন্দু অধ্যুষিত ফরিদপুরের ভাঙ্গাতে ছিল একটি সাংস্কৃতিক পরিবেশ। শৈশবে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে গলা ছেড়ে কীর্তন ও বাউল গান গাইতেন। বিভিন্ন গানের আসরে উপস্থিত হতেন। এক্ষেত্রে তার পিতারও উত্সাহ ছিল। তিনি তাকে গানের আসরে নিয়ে যেতেন। বাড়িতে রেডিও শোনা এবং  রেডিওতে গান শেখার অনুষ্ঠান মনোযোগ দিয়ে শুনে সুর মিলিয়ে গান করা; আর এভাবেই ফকির আলমগীরকে সংগীত জগতে টেনে আনে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেশের জন্য কাজ করার পর তার দায়বদ্ধতা আরো বেড়ে যায়। একদিকে দেশপ্রেম অন্যদিকে মানবপ্রেম তাকে সারা জীবন গণসংগীতের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে উদ্দীপিত করে। তার মতে, ‘সংগীতের সঙ্গে যখন ‘গণ’ শব্দটি যুক্ত হয়ে এক ভিন্নধর্মী সংগীত ভাষার জন্ম দেয় তখন তাকে আমরা গণসংগীত বলি। গণসংগীত মুক্তির গান, শোষণ মুক্তির গান এবং মানবমুক্তির গান। সংগীত আমাদের বিশ্বস্ত সহচর।

মানুষের জন্য গান নিয়ে জীবন কাটানো ফকির আলমগীর বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন দেশে নিজের গাওয়া গান পরিবেশন করেছেন। বিশ্বের ৩০টির বেশি দেশে তিনি সংগীত পরিবেশন করেছিলেন। বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু ভাষায় যেমন গান করেছেন, তেমনি চায়নিজ, কোরিয়ান, জাপানিজ ভাষাসহ বিশ্বের যখন যে দেশে গেছেন, সেই দেশের ভাষায় গান তুলে পরিবেশন করেছেন। ১৯৭৭ সালে প্রথম কালচারাল ডেলিগেট হিসেবে আফগানিস্তান সফর করেন। এরপর বিভিন্ন দেশে গেছেন।

১৯৭১ সালে সরাসরি তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। প্রথমে ১ জুলাই ভারতে ট্রেনিংয়ের জন্য যান। এরপর যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধের ময়দানে যখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনতেন, মনে হতো তাকে সেখানে গিয়েই গানের মাধ্যমে যুদ্ধ করতে হবে। আর সেটাই তিনি করেছিলেন। যশোর রোড ধরে গিয়েছিলেন। মৌসুমী ভৌমিকের যশোর রোডের গানটি তিনি কোনো দিন ভুলতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের উত্তাল ভাষণ শুনে কম বয়সের অনেকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। রাজপথে দুরন্ত মিছিলে সবাই ছুটে এসেছিল রেসকোর্স ময়দানে। বঙ্গবন্ধুর বজ্র কণ্ঠ ভেসে আসে তার কানে। তিনি যেন কবিতার ঢেউ ঠেলে দিয়েছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধু সেই ভাষণের মধ্য দিয়ে দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতারের গান সরাসরি সম্প্রচার হতো। একটা মাইক্রোফোন দিয়ে তবলা, দোতারা, হারমোনিয়ামে ও মন্দিরার সাউন্ড যেত। সেই সময় অনেক কষ্ট করে তিনি গান করেছেন। সেটাকে স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রস্তুতির গান, স্বাধীন বাংলা বেতারের গান ও মুক্তির গান—এই তিন পর্বে ভাগ করা যায়। এই শিল্পীর স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নেওয়ার স্বপ্ন ছিল শোষণহীন ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার। কিন্তু এটা বাস্তবায়িত হয়নি বলে তার আক্ষেপ ছিল।

ফকির আলমগীর চেয়েছিলেন গণসংগীতকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর পরিধি বাড়াতে। ভবিষ্যতে গণসংগীতের শিল্পী পাওয়ার প্রত্যাশা থেকে ‘গণসংগীত একাডেমি’ করার ইচ্ছে ছিল তার। তার আকস্মিক প্রয়াণ কাজগুলো অসমাপ্ত রেখে গেছে। আসলে শিল্প-সাহিত্য কেবল আনন্দ-বিনোদনের জন্য নয় বরং সমাজের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সংগীত ও লেখনি কাজ করতে পারে। তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন ফকির আলমগীর।

প্রবন্ধঃ

ফকির আলমগীরঃ স্মরণে থাকবেন
মিল্টন বিশ্বাস, অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইত্তেফাক
২৫ জুলাই ২০২১

ভিডিও ফুটেজঃ নিউজ২৪ ফুটেজ (২০১৮)

মন্তব্যসমূহ
বই পড়তে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি' এ্যাপটি ব্যবহার করুন।

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button