বই-দলিলপত্র-প্রবন্ধসকল কনটেন্ট
Trending

আমাদের কূটনীতিক মুক্তিযোদ্ধা – সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী

বই পড়তে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি' এ্যাপটি ব্যবহার করুন।

আমাদের কূটনীতিক মুক্তিযোদ্ধা
সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী
আমাদের কূটনীতিক মুক্তিযোদ্ধা

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার। বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত আহ্বানে দেশের সব পেশার জনগণ এ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। সেনাবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকরা রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছিলেন। একইভাবে আমাদের শিল্পী, প্রশাসক, শিক্ষক, এমনকি বিদেশে কর্মরত বাঙালি কূটনীতিকরা এ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের অবদান সারা দেশ, জাতি স্মরণ করবে। সুখের কথা, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কয়েকজন সম্মানিত হয়েছেন, পদক পেয়েছেন। কারও কারও নামে সড়ক বা ভবন উৎসর্গিত হয়েছে। তবে একটা দলের বিরাট অবদান সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয়েছে, তারা হচ্ছেন আমাদের মুক্তিযোদ্ধা কূটনীতিক।

সাধারণত কূটনীতিকরা যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়েন না। ‘শীতল যুদ্ধ’ বা অধুনা বালকান বা আরব বসন্ত যুদ্ধেও নগণ্য সংখ্যক কূটনীতিক ‘ডিফেকশন’ বা দলত্যাগ করেছেন। কিন্তু হাজার মাইল দূরে বসেও আমাদের হাতেগোনা কয়েকজন বাঙালি কূটনীতিক পাকিস্তান সরকার ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন ও কূটনীতিক ফ্রন্টে পাকিস্তানিদের মোকাবিলা করেন। তাদের কোনো নিরাপত্তার অভাব বিদেশে ছিল না, তবুও তারা এগিয়ে আসেন ও স্বেচ্ছায় ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধে নামেন। তারা ভালো করেই জানতেন, দখলদার বাহিনী যে কোনো সময় তাদের দেশে থাকা মা-বাবা, ভাইবোনদের ওপর অত্যাচার করতে পারে ও মেরে ফেলতে পারে। তবুও তারা সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে আমাদের কূটনীতিকদের একযোগে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ বিরাট চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে ও সেসব দেশের প্রশাসনের ওপর বিরাট চাপও সৃষ্টি করে। অন্যদিকে তাদের এ প্রয়াস আমাদের যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করে।

এটা ঠিক, সিংহভাগ বাঙালি কূটনীতিক যারা বিদেশে নিয়োজিত ছিলেন তারা এ ধরনের সাহসী পদক্ষেপ নেননি। কিন্তু যারা নিয়েছিলেন তারা আমাদের দেশের গৌরব। তাদের মূল্যায়ন ও যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা প্রয়োজন।

মুজিবনগরের বাংলাদেশ সরকার গঠনের আগে যে দুজন কূটনীতিক বাংলাদেশের পক্ষে সর্বপ্রথম আনুগত্য প্রদর্শন করেন, তারা হচ্ছেন নয়াদিলি্লর পাকিস্তানের হাইকমিশনারের দ্বিতীয় সচিব কে এম সাহাবউদ্দিন ও সহকারী প্রেস অ্যাটাশে আমজাদুল হক। তারা এ ঘোষণা দিলেন এপ্রিল মাসে। নভেম্বরে কাউন্সিলর হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ও অন্যান্য স্টাফও আনুগত্য প্রকাশ করেন। কিন্তু ভারতে আমাদের কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কলকাতায়। ১৮ এপ্রিল ‘৭১ অর্থাৎ সরকার গঠনের একদিন পর কলকাতার পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার মোহাম্মদ হোসেন আলী এবং সব বাঙালি কূটনীতিক ও স্টাফ একযোগে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য জানান। রাতারাতি সেখানে স্থাপিত হলো বাংলাদেশ মিশন। পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উঠালেন হোসেন আলী। তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। অন্য কর্মকর্তা যারা তাকে সহযোগিতা করেন তারা হলেন প্রথম সচিব রফিকুল ইসলাম, তৃতীয় সচিবদ্বয় আনোয়ারুল করীম চৌধুরী ও কাজী নজরুল ইসলাম এবং সহকারী প্রেস সচিব মকসুদ আলী।

তখন যুক্তরাজ্যে আমাদের দেশি লোক সবচেয়ে বেশি বসবাস করত। অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণে সেখানে আমাদের প্রবাসীরা স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন। কিন্তু লন্ডনের পাকিস্তানের দূতাবাসের কর্মরত বাঙালি ঊর্ধ্ববতন কর্মকর্তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামে যোগ দেননি। যিনি নেতৃত্বে ছিলেন, তিনি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। জেনেভায় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য হিসেবে মিটিং করার পর লন্ডনে ফিরে এপ্রিল মাসেই বাংলাদেশের পক্ষে ঘোষণা দিলেন। তাকে মুজিবনগর সরকার ‘অ্যাম্বাসেডর অ্যাট লার্জ’ হিসেবে নিয়োগ দিল। লন্ডনে দূতাবাসের প্রথম যে কূটনীতিক বের হয়ে এলেন, তিনি দ্বিতীয় সচিব মহিউদ্দিন আহমেদ। বাংলাদেশ মিশন প্রতিষ্ঠিত হলো ১৭ আগস্ট। আরও তিন কূটনীতিক হাবিবুর রহমান, লুৎফুল মতিন ও ফজলুল হক চৌধুরী বাংলাদেশ মিশনে যোগ দিলেন। পরে সিনিয়র কূটনীতিক কাউন্সিলর রেজাউল করীম মিশনে যোগ দিলেন।

কিন্তু ভারতের বাইরে সবচেয়ে বড় দলবেঁধে ‘ডিফেকশন’ হয় ওয়াশিংটন ডিসিতে। সেখানে একযোগে ১৪ জন কূটনীতিক ও স্টাফ একসঙ্গে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করলেন ৪ আগস্ট, ১৯৭১। দলের নেতৃত্ব দেন সৈয়দ আনোয়ারুল করীম, জাতিসংঘে পাকিস্তানের উপ-প্রধান প্রতিনিধি ও মিনিস্টার। দলে ছিলেন এনায়েত করীম, মিনিস্টার, ওয়াশিংটনস্থ পাকিস্তানের উপ-মিশন প্রধান। কাউন্সিলর শাহ এমএস কিবরিয়া, অর্থনৈতিক কাউন্সিলর আবুল মাল আবদুল মুহিত, শিক্ষাবিষয়ক কাউন্সিলর সৈয়দ আবুল রশীদ মতীন উদ্দিন, দ্বিতীয় সচিব (হিসাব বিভাগ) আতাউর রহমান চৌধুরী ও তৃতীয় সচিব (রাজনৈতিক) সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী। তিনজন স্থানীয়ভিত্তিক কর্মকর্তা শরফুল আলম, শেখ রুস্তম আলী ও আবদুর রাজ্জাক খান। এ দলে যোগ দেন।

এনায়েত করীম তখন দ্বিতীয়বার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ছিলেন সিসিইউতে। তাকে বারবার বলা হয়, রোগমুক্তির পর যে কোনো সময় আমাদের মিশনে যোগ দিতে পারবেন। কিন্তু তিনি রাজি হলেন না। দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘মরতে হলে বাঙালি হিসেবে মরব, পাকিস্তানি হিসেবে নয়’। তার পক্ষে তার স্ত্রী হোসনে আরা করীম আমাদের ওয়াশিংটন প্রেস কনফারেন্সে উপস্থিত ছিলেন।

ওয়াশিংটনে এত বড় ধরনের ‘ডিফেকশন’ এর আগে এবং পরেও কখনো হয়নি। কাজেই সারা আমেরিকায় ও আন্তর্জাতিক মণ্ডলে বিরাট চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলো। নিঙ্ন প্রশাসন পাকিস্তানের প্রতি দৃঢ় সমর্থন দিয়ে আসছিল, তারা কিছুটা বেকায়দায় পড়ল। আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানরা পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য না দেওয়ার সচেষ্ট ভূমিকা নিলেন। হাউসে ‘গালাঘার অ্যামেন্ডমেন্ট পাস হলো। একইভাবে সিনেটে সেঙ্বি চার্চ আমেন্ডমেন্ট পাস হলো। দুই কক্ষের পাস করা অ্যামেন্ডমেন্টের একই লক্ষ্য পাকিস্তানের রাজনৈতিক সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত সামরিক ও বেসামরিক মার্কিন সাহায্য বন্ধ রাখতে হবে। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ মিশন স্থাপন করা হলো। মিশন প্রধান হিসেবে মুজিবনগর সরকার সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিককে পাঠাল।

নিউইয়র্কে সৈয়দ আনোয়ারুল করীব ও ভাইস কনসাল মাহমুদ আলীকে নিয়ে মিশন গঠিত হলো। রাষ্ট্রদূতদের মধ্যে সবচেয়ে প্রথম আনুগত্য স্বীকার করেন বাগদাগের পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আবুল ফাতেহ, পরে ম্যানিলার রাষ্ট্রদূত খুররম খান পন্নী ও আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত আবদুল মোমেন যোগ দিলেন। তাদের এই বিশেষ অবদান ভোলার নয়। তারা বিভিন্ন দেশ সফর করে আমাদের পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টি করেছেন।

অন্য কূটনীতিকদের মধ্যে কায়রোর দ্বিতীয় সচিব ফজলুল করীম, লাগোসের তৃতীয় সচিব মহীউদ্দিন জায়গীরদার, তিউনিসিয়ার তৃতীয় সচিব সৈয়দ আমীরুল ইসলাম বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে লন্ডন মিশনে যোগদান করেন।

পরে নেপালের দ্বিতীয় সচিব মুস্তাফিজুর রহমান, টোকিওর প্রেস কাউন্সিলর এসএম মাসুদ ও তৃতীয় সচিব কমর রহীম, হংকংয়ের ভারপ্রাপ্ত বাণিজ্য মিশন প্রধান মহিউদ্দিন আহমেদ ও সুইজারল্যান্ডের ওয়ালিউর রহমান যোগ দেন। তাদের নিজ নিজ রাজধানীতে মিশন খোলার নির্দেশ দেওয়া হয়।

পূর্ব ও পশ্চিমা শক্তির মধ্যে তখন চলছিল ‘শীতল যুদ্ধ’। ফলে তারা বিভক্ত ছিল। একমাত্র ভারত ও তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতারা আমাদের ন্যায্য অধিকার আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। নিঙ্ন প্রশাসন আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে তাদের ‘শীতল যুদ্ধের’ পরিমণ্ডলে বিচার করেছেন। তখন তারা ইসলামাবাদের সাহায্যে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে ব্যস্ত ছিলেন, যাতে মস্কোকে কোণঠাসা করা যায়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশে যে গণহত্যা চলছিল, তাকে তারা সম্পূর্ণ অবহেলা করেছেন। পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর সরকারগুলো আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকলেও মার্কিনিদের সরাসরি বিরোধিতা করার সাহস দেখায়নি। গণপ্রজাতন্ত্রী চীন, যার সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বাঙালিরাই নেতৃত্ব দেয়, তারাও আমাদের সমর্থন দেয়নি। তারা তাদের মিত্র দেশ পাকিস্তানের ‘ভাঙন’ আটকাতে চেয়েছিল। আরব বিশ্ব সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের ভাগ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা মানতে চায়নি। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার ভারত ও ভুটান ছাড়া বাকি রাষ্ট্রগুলো আমাদের সমর্থন দেয়নি।

এরকম জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে ও কূটনৈতিক ফ্রন্টে যুদ্ধ চালানোর প্রস্তুতি নিতে আমাদের মুজিবনগর সরকারের কিছুটা সময় লাগে। বিদেশে মিশন চালানো খরচ বহনের জন্য বৈদেশিক অর্থের ব্যবস্থা করতে হয়।

আমাদের কূটনৈতিক অঙ্গনে চালানোর লক্ষ্য ছিল আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলকে সঠিকভাবে তুলে ধরা, যাতে বিদেশি রাষ্ট্রনায়করা আমাদের সমর্থনে এগিয়ে আসেন। নব্য স্বাধীন এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো ভারত, আমাদের সমর্থন করলেও তাদের শঙ্কা ছিল যে, তাদের দেশেও বিচ্ছিন্নতার আন্দোলন সচল হবে ও তাদের রাষ্ট্র সংহতি বিপন্ন হবে। অন্যদিকে যেহেতু পাকিস্তান ভারতের মধ্যে রেষারেষি ছিল, অনেকেই ভাবতেন, আমাদের এই মুক্তিযুদ্ধ হয়তোবা তাদের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় স্নায়ুযুদ্ধের ফসল। এ ছাড়া অনেকের দৃঢ় সন্দেহ ছিল, বায়াফ্রা যুদ্ধের মতো আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়তো ব্যর্থ হবে। পাকিস্তানের কিছু সহযোগী দেশ বিহারিদের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিল। মোদ্দা কথা, সহানুভূতিশীল দেশগুলোরও আমাদের ব্যাপারে অনেক দ্বিধা ছিল। ওইসব দেশের সঙ্গে আলাপ করা এবং দ্বিধা ও সংশয়ের অবসান ঘটানো একটা বড় কাজ ছিল। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল, আমাদের জনগণের ওপর যে গণহত্যা চলছিল, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছিল, তা তুলে ধরা এবং পাকিস্তানে সব সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করা। তৃতীয়ত, যেসব সহানুভূতিশীল দেশ ছিল, তাদের সমর্থন বজায় রাখা ও স্বীকৃতি দিতে উৎসাহী করা।

বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে একটি প্রতিনিধিদল পাঠায়, যার নেতৃত্ব দেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। আমাদের প্রতিনিধি দল বিভিন্ন দেশের দলের সঙ্গে ব্যাপক লবিং করে। যখন ডিসেম্বরের গোড়ায় যুদ্ধ শুরু হলো, বিচারপতি চৌধুরী বিশেষ তৎপরতায় নিউইয়র্কে এলেন ও ভাষণ দেওয়ার অনুমতি চাইলেন। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদ জাতিসংঘের সদস্য না হওয়ায় তাকে সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি। নিরাপত্তা পরিষদে পশ্চিমা দেশগুলো যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য ও ভারত-পাকিস্তানের সৈন্যদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃত নিজ নিজ সীমান্তে ফিরে যাওয়ার জন্য পর পর তিনটা প্রস্তাব দেয়। কিন্তু আমাদের পরম মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের ভেটো দিয়ে বন্ধ করে। কারণ এ প্রস্তাবগুলো আমাদের রাজনৈতিক সমস্যাকে সম্পূর্ণ ধামাচাপা দিতে চেয়েছিল।

পাকিস্তানকে ‘নতুন জীবন’ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র সপ্তম নৌবহর আমাদের সমুদ্রসীমায় পাঠায় ও চীনকে উত্তর ভারতে আক্রমণ চালাতে বলে, যাতে ভারতকে ভয় দেখিয়ে নিবৃত্ত করা যায়। সোভিয়েত তাদের নৌবহর পাঠায় ও চীন সীমান্তে সেনা মোতায়েন করে। ফলে চীন ভারত সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করা থেকে নিবৃত্ত থাকে।

চরম উত্তেজনাময় মুহূর্তের মধ্য দিয়ে সময় বয়ে যায়। পশ্চিমাদের আশা ছিল যদি যুদ্ধ এক মাস পাকিস্তান চালাতে পারে, তাহলে যুদ্ধ বিরতির জন্য আবারও প্রচেষ্টা নেওয়া হবে এবং জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা বাহিনী সীমান্তে মোতায়েন করা হবে। তাদের ইচ্ছা পূরণ হয়নি। কেবল বাহিনীর আচমকা প্রচণ্ড আঘাতে পাকিস্তানিরা ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে আত্দসমর্থন করে। বাংলাদেশ মুক্ত হয়। দেশ মুক্ত হওয়ার মাত্র ছয় মাসের মধ্যে বড় বড় দেশ আমাদের স্বীকৃতি দেয় এবং ব্যাপক সাহায্য ও সহযোগিতার জন্য হাত বাড়ায়।

কূটনীতিক মুক্তিযোদ্ধারা সবাই অবসর নিয়েছেন। তাদের মধ্যে যে সিনিয়র কূটনীতিকরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু তাদের অসামান্য কৃতিত্ব ও অবদান স্মরণ করে সম্মান দেখানো হয়নি। একমাত্র তদানীন্তন পররাষ্ট্র সচিব কিবরিয়ার তৎপরতার কারণে এনায়েত করীমকেও পরে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়। গত চার দশকে আমাদের কোনো মুক্তিযোদ্ধা কূটনীতিককে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয়নি। এ ব্যাপারে সরকারের বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। যদি আমরা আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা কূটনীতিকদের সম্মান না দিই, তবে আজকের নবীন কূটনীতিকদের কিভাবে দেশপ্রেমী হতে উদ্বুদ্ধ করতে পারব? সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে হলে অতীতকে অবশ্যই জানতে হবে।

লেখক : সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও একজন মুক্তিযোদ্ধা কূটনীতিক

প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় ২৬ মার্চ, ২০১৪ তাারিখে।

মন্তব্যসমূহ
বই পড়তে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি' এ্যাপটি ব্যবহার করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button