বেঙ্গল রেজিমেন্টের যুদ্ধযাত্রা ১৯৭১ – মেজর এস. এম. সাইদুল ইসলাম (অবঃ)
বেঙ্গল রেজিমেন্টের যুদ্ধযাত্রা ১৯৭১
মেজর এস. এম. সাইদুল ইসলাম (অবঃ)
২০১৮
আমি মুক্তিসংগ্রামকে দেখি একটি দীর্ঘ রিলে রেসের মতো, যার ফাইনাল ল্যাপটি শুরু হয়েছিল সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার সাথে সাথে। এই রেসের প্রতিটি প্রতিযোগীর প্রাণপণ প্রচেষ্টার যোগফল আমাদের চূড়ান্ত বিজয়, আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের মানচিত্র। বেঙ্গল রেজিমেন্টের যুদ্ধযাত্রা ১৯৭১, মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্বের উপাখ্যান। শৃঙ্খলাপরায়ণ সেনাবাহিনীর স্বাধীনতার জন্যে সশস্ত্র বিদ্রোহের ডকুফিকশন। মুক্তির জন্যে নিরস্ত্র শান্তিকামী সশস্ত্র হয়ে ওঠার কাহিনী।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি অতর্কিত আক্রমণের প্রায় সাথে সাথেই আত্মরক্ষায় মরীয়া প্রচেষ্টা হিসেবে জনতা তার জবাব দিতে শুরু করে। একই সময়ে অপারেশন সার্চলাইটের আওতায় বাঙালি সৈনিকদের নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ায় নিকটস্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ইউনিটের নেতৃত্ব মেনে পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। রাজনৈতিক নির্দেশনা এবং পারস্পরিক সমন্বয়হীন এই বিদ্রোহ মূলতঃ পাকিস্তানি আক্রমণ অথবা আক্রমণ পরিকল্পনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে সংঘটিত হওয়ায় পাঁচটি ইউনিটে যুদ্ধ শুরু হতে পাঁচ দিন লেগে যায়। বিদ্রোহের প্রাথমিক সাফল্য তরুণ অফিসার, সৈনিক এবং সেনানিবাস সংলগ্ন এলাকার জনগণের মধ্যে ব্যাপক আশার সঞ্চার করলেও, এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল ভেবে বিদ্রোহের নেতারা বিজয়ের স্থায়িত্ব নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। অধীনস্তদের নিরাপত্তা, বিজয় ধরে রাখার জন্যে প্রয়োজনীয় রসদ ও যুদ্ধ সরঞ্জামের পাশাপাশি বিদ্রোহের সামরিক-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ তাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
অপরদিকে বেতার ঘোষণা, ওয়্যারলেস ইন্টারসেপশন, প্রাণভয়ে শহর ছেড়ে পালিয়ে আসা মানুষ, সীমান্ত অভিমুখী শরণার্থী ও পাকিস্তানি বন্দিদের মাধ্যমে বিদ্রোহী ইউনিটগুলোর কাছে দেশের নানান জায়গায় সংঘটিত জনযুদ্ধের খন্ডচিত্র পরিস্ফুট হতে থাকে। ইতোমধ্যে দেশের নানান এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া ইপিআর, পুলিশ এবং তাৎক্ষণিকভাবে সংগঠিত বিভিন্ন দল, উপদল প্রাথমিক প্রতিরোধযুদ্ধে তাদের অর্জিত বিজয় সংহত করা অথবা পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবার লক্ষ্যে বেঙ্গল রেজিমেন্টের পতাকা তলে সমবেত হতে থাকে। দলছুট যোদ্ধার সাথে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সম্মিলনে গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী।
এই সূত্রে ইউনিটগুলো পরস্পরের সাথে যোগাযোগ শুরু করার পর সমন্বয়হীনতার সংকট কেটে যেতে থাকে। পারস্পরিক যোগাযোগ স্থাপনের পর বিদ্রোহের নেতাদের কাছে তিনটি বিষয় তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়।
১। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া এই অসম যুদ্ধে জয়লাভ করা প্রায় অসম্ভব।
২। রাজনৈতিক সরকার ছাড়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি অর্জন সম্ভব নয়।
৩। বৈধ সরকার গঠন ছাড়া তাদের এই যুদ্ধ শুধুমাত্র বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহ হিসাবে বিবেচিত হবে।
সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে বিদ্রোহী ইউনিটের অধিনায়কগণ ৪ঠা এপ্রিল হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়ায় কর্নেল এম এ জি ওসমানী ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুর রবের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন। ভারতীয় বিএসএফের ব্রিগেডিয়ার পান্ডের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে সদ্যগঠিত মুক্তিবাহিনীর নেতৃবৃন্দ কর্নেল ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর সার্বিক নেতৃত্ব গ্রহণে রাজী করান এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করে সরকার গঠনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতার পথ উন্মুক্ত করার আহ্বান জানান। মাত্র দেড় সপ্তাহ আগে পাকিস্তানি বাহিনীর অতর্কিত হামলার প্রতিক্রিয়ায় রাজনৈতিক নির্দেশনা ছাড়া, সমন্বয়হীনভাবে যে খন্ডযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তেলিয়া পাড়া সম্মেলনের ফলে সেটিই পরিণত হয় ধ্রুব লক্ষ্যে যুদ্ধযাত্রায়।
আমার গবেষণা বেঙ্গল রেজিমেন্ট নির্ভর বলেই এই রেজিমেন্টের সাথে সম্পৃক্ততার কারণে চট্টগ্রাম ও কুষ্টিয়ায় ইপিআরের প্রতিরোধ যুদ্ধের কথাও এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার, ৮ ইস্টবেঙ্গল এবং ইপিআর চট্টগ্রাম সেক্টরের প্রাথমিক প্রতিরোধ একই সূত্রে বাঁধা। আর কুষ্টিয়ার যুদ্ধ ইপিআরের পাশাপাশি মুক্তির জন্যে নিরন্তর শান্তিকামী জনতার সশস্ত্র হয়ে ওঠার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। (লেখককের কথা)
সাইদুল ইসলাম। অনেকদিন ধরে মুক্তিযুদ্ধের
ইতিহাস নিয়ে কাজ করছেন। মুক্তিযুদ্ধকে তিনি
দেখেন একটি দীর্ঘ রিলে রেসের মত, যার
ফাইনাল ল্যাপটি শুরু হয়েছিল সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু
তা হবার সাথে সাথে। এই রেসের প্রতিটি প্রতিযােগীর
প্রাণপন প্রচেষ্টার যােগফল আমাদের চুড়ান্ত বিজয়।
আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের মানচিত্র।
২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাদের অতর্কিত
আক্রমণের প্রায় সাথে সাথেই জনতা যখন তার
জবাব দিতে শুরু করে, একই সময়ে বাঙালি
সৈনিকদের নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ায়
নিকটস্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ইউনিটের নেতৃত্ব মেনে
পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা যুদ্ধে
ঝাপিয়ে পড়ে। সুস্পষ্ট রাজনৈতিক নির্দেশণা এবং
পারস্পারিক সমন্বয়হীন এই বিদ্রোহ মূলতঃ
পাকিস্তানি আক্রমণ অথবা আক্রমণ পরিকল্পনার
তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে সংঘটিত হওয়ায়
পাঁচটি ইউনিটে যুদ্ধ শুরু হতে পাচদিন লেগে যায়।
দেশের নানান এলাকায় বিচ্ছিন্ন ভাবে যুদ্ধে
জড়িয়ে, ইপিআর, পুলিশ এবং সাধারণ মানুষের
সমন্বয়ে তাৎক্ষণিক ভাবে সংগঠিত বিভিন্ন দল,
উপদল প্রাথমিক প্রতিরােধযুদ্ধে তাদের অর্জিত
বিজয় সংহত করা অথবা পরাজয়ের প্রতিশােধ
নেবার লক্ষে বেঙ্গল রেজিমেন্টের পতাকা তলে
সমবেত হতে থাকে । সামরিক জান্তার রক্তচক্ষু
উপেক্ষা করে দেশব্যাপী জনযুদ্ধে জড়িয়ে পড়া
এইসব দলছুট যােদ্ধার সাথে বেঙ্গল রেজিমেন্টের
সম্মিলনে গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী।
সাইদুল ইসলামের লেখা বৈঠকি গল্পের মত।
প্রথমে তিনি পাঠককে লেখার সাথে সম্পৃক্ত করে
ফেলেন, তারপর শুরু হয় পাঠকের সাথে তার পথ
পরিক্রমা। বেঙ্গল রেজিমেন্টের যুদ্ধ যাত্রাও তার
ব্যাতিক্রম নয়। এটি মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্বের
উপাখ্যান।
শৃঙ্খলা পরায়ন সেনাবাহিনীর
স্বাধীনতার জন্যে সশস্ত্র বিদ্রোহের ডকু ফিকশন।
মুক্তির জন্যে নিরস্ত্র শান্তিকামী জনতার সশস্ত্র হয়ে
ওঠার কাহিনী।