বই-দলিলপত্র-প্রবন্ধসকল কনটেন্ট
Trending

ভালোবাসা দিবসে ভালোবাসা দিও সূর্যসন্তানদেরও

বই পড়তে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি' এ্যাপটি ব্যবহার করুন।

ভালোবাসা দিবসে ভালোবাসা দিও সূর্যসন্তানদেরও

লেখকঃ সাব্বির হোসাইন

১.

মানুষটি কোন বিপ্লবী নন, ফেসবুকার নন, লেখক নন, একটিভিস্ট নন; তিনি একেবারে আমজনতা, এই জনপদের সাধারণ মানুষদের একজন; যিনি দেশকে ভালোবেসেছিলেন…

তার নাম জাফর মুন্সী; নিম্ন আয়ের একজন চাকুরে ছিলেন।
তিনি দেশকে ভালোবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন তার পেশাকে।
ছোট একটি চাকুরি করতেন; মতিঝিলে অবস্থিত অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান শাখার লিফটম্যানের কাজ করতেন।

তার স্বপ্নের মত সুন্দর একটি সংসার ছিল; হ্যাঁ, সেই সংসারে অভাব ছিল, জীবনের টানাপোড়ন ছিল কিন্তু এসবের চেয়ে বড় ছিল তার স্বপ্ন, এক মেয়ে জেবা আর দুই ছেলে যুবরাজ ও জিসান আর স্ত্রী জুলিয়াকে নিয়ে ছিল তার সাজানো ছোট সংসার।
স্বপ্ন দেখতেন তার মেয়ে চিকিৎসক হবে আর ছেলেরা হবে পাইলট। জীবনের নানা প্রতিকূলতায় নিজে যে জায়গায় পৌঁছুতে পারেননি, চেয়েছিলেন তাঁর সন্তানরা সে জায়গায় পৌঁছুবে।

ফরিদপুর জেলার ভাংগা উপজেলার ঘারুয়া ইউনিয়নের গঙ্গাধরদী গ্রামে জন্মেছিলেন জাফর মুন্সী।
বাবা-মা’কে পরিণত বয়সে পৌঁছুনোর আগেই হারান।
জীবন থেকে প্রতারিত হয়েছেন বারবার।
ছোট চাকুরি করেও পরিবারকে ভালো রাখার, স্ত্রী-সন্তানের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টায় তার কোন কমতি ছিল না।

জীবনে টিকে থাকার সংগ্রামে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকলেও দেশ সচেতন, রাজনীতি সচেতন ছিলেন জাফর মুন্সী।
নিজের অবস্থান হতে দেশের জন্য কাজ করার প্রত্যয়ী ছিলেন।
জাতীয় শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত অগ্রণী ব্যাংক কর্মচারী সংসদের কার্যনির্বাহী সদস্য ছিলেন।

২০১৩ সাল; বাঙালির একাত্তরের ভুলতে বসা চেতনা পুনর্জীবিত হবার বছর।
২০১৩ সালের ০৫ ফেব্রুয়ারি, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের যথাযথ শাস্তির দাবিতে সারা বাংলাদেশে সোচ্চার হয়ে উঠে; সূচনা হয় শাহবাগ-আন্দোলনের।
সকল পেশা, মতের মানুষরা একাত্ম হয়ে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের যথাযথ শাস্তি দাবি করে।
১২ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ আন্দোলনের সমর্থনে অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তিন মিনিট নীরবতা কর্মসূচী পালন করে, যাতে অংশগ্রহণ করেছিলেন জাফর মুন্সী।

আধুনিক বিশ্বে একটি বৃহৎ অহিংস আন্দোলন হিসেবে খ্যাত এই ‘শাহবাগ আন্দোলনের’ বিপরীতে দাঁড়ানো একাত্তরের পরাজিত শক্তি জামাত-শিবিররা ছিল সহিংস।
সারা বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ, আন্দোলনকারী ও পুলিশকে লক্ষ্যবস্তু করে আঘাত হানতে থাকে জামাত-শিবির।
১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সকালে জামাত-শিবিরের একদল সন্ত্রাসী লাঠিসোঁটা, চাপাতি ও রড নিয়ে মতিঝিলে অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অগ্রণী ব্যাংকে হামলা চালায়; শাহবাগ-আন্দোলনের সমর্থনে অগ্রণী ব্যাংকের কর্মচারী-কর্মকর্তা কর্তৃক লাগানো ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে এবং ব্যাংক কর্মচারী-কর্মকর্তাদের আক্রমণ করা সহ ব্যাংকের ভিতরে প্রবেশ করতে চায়।
জামাত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা ব্যাংকের ভিতরে ঢুকতে চাইলে লিফটম্যান জাফর মুন্সী বাঁধা দেয়।
জামাত-শিবিরের হায়েনারা ঝাঁপিয়ে পড়ে জাফর মুন্সীর উপর; এতে তার মাথা ও ঘাড়ে গুরুতর জখম হয়।

রক্তাক্ত, গুরুতর আহত অবস্থায় জাফর মুন্সীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়।
সেখান থেকে পরে তাকে গ্রিন লাইফ হাসপাতালের আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) ভর্তি করানো হয়।

কিন্তু জাফর মুন্সী আর সুস্থ হলেন না।
আর দেখলেন না স্ত্রী-সন্তানদের প্রিয় মুখ।
তার স্বপ্নের ইতি টেনে গেল।

১৪ ফেব্রুয়ারি দুপুর সোয়া ১২টার দিকে জাফর মুন্সী হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন…

জাফর মুন্সী একেবারেই বাংলাদেশের আমজনতাদের একজন ছিলেন।
পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে, দেশপ্রেমে উজ্জীবিত জাফর মুন্সী জামাত-শিবিরের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।
দেশপ্রেমের এরকম নির্জলা নজির আমাদের এই স্বার্থপর সমাজে খুব বেশি দেখা যায় না।

২.

বিশ্বায়নের কল্যাণে ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে ঘটা করে ভালোবাসা দিবস উদযাপন করা হয়।
এতে দোষের বা ভ্রুকুটি করার কিছু নেই।
সভ্যতার এই পরিবর্তন প্রকৃতির নিয়ম ভেবেই মেনে নেয়া উচিত।
পরিবর্তনের এই গ্রহণযোগ্যতার সাথে নিজেদের ইতিহাস স্মরণ রাখাও সমান তালে জরুরি; নয়তো সভ্যতা, সমাজ-কাঠামো টিকে থাকবে না, ন্যায়-নৈতিকতা-আইন-মানবিকতা যে স্টাবলিশমেন্ট তা টিকবে না; আর এসব না টিকলে সমাজের কি বেহাল দশা হয়, তা বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ সরকার ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোগুলোতে দেখেছি।

১৪ ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় ইতিহাসে দুটো ঘটনার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ-

১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মজিদ খান শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে স্বৈরাচার এরশাদের বাহিনী গুলি করে ও গাড়ি চাপা দিয়ে কমপক্ষে দশজনকে হত্যা করে। স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ১৪ ফেব্রুয়ারি আমাদের কাছে অবশ্যই স্মরণীয় ও পালনীয়; কারণ, আজ যে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা ভোগ করছি, তা অর্জনে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনকারীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য ও ব্যাপক।

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের যথাযথ শাস্তির দাবিতে যখন সারা দেশ উত্তাল, পুরো বাংলাদেশে গণজাগরণের সূচনা হয়, শাহবাগ-আন্দোলনের জন্ম হয়, সারা দেশের সর্বস্তরের জনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে; তখন যুদ্ধাপরাধীদের দল জামাত-শিবির সারা দেশে সাধারণ জনতা, আন্দোলনকারী, পুলিশ ও অফিস-আদালতকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে সন্ত্রাসী হামলা চালায়; সে সময় জামাত-শিবিরের এরকম একটি হামলায় ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মতিঝিলে অগ্রণী ব্যাংকের লিফটম্যান জাফর মুন্সী মারাত্মক আহত হন এবং পরদিন ১৪ ফেব্রুয়ারি মারা যান।

বর্তমানে একাত্তরের দালাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে; তারা তাদের কৃতকর্মের প্রাপ্য শাস্তি পাচ্ছে। দীর্ঘ চার দশক অপেক্ষা করে এই বিচার পাচ্ছে বাঙালি জাতি; কলঙ্কমোচন, দায়মুক্তি ও বিচারপ্রাপ্তির এই দীর্ঘ ও রক্তাক্ত সংগ্রামের পথে জাফর মুন্সী একটি চিরভাস্মর ও স্মরণীয় একটি নাম।

যারা সুন্দর একটি বাংলাদেশের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন, সংগ্রাম করেছেন, আন্দোলন করেছেন; তাদের ভুলে গেলে তো আমাদের চলবে না, সেইসব আন্দোলন-সংগ্রাম ভুলে গেলে আমাদের চলবে না; এসব ভুলে গেলে নিজেদের পায়েই যে কুড়োল মারা হবে।

তাই জাতির এই সূর্যসন্তানদের জন্যও যেন থাকে আমাদের ভালোবাসা ও তার বহিঃপ্রকাশ…

তথ্য সহায়িকা:

১. দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ’ জাফর মুন্সী নিজ গ্রামে সমাহিত – দৈনিক জনকণ্ঠ, ১৬ ফেব্রুয়ারি  ২০১৩
২. শিবিরের হামলায় আহত ব্যাংক কর্মচারীর মৃত্যু – দৈনিক প্রথম আলো, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩
৩. জামায়াত-শিবিরের হামলায় আহত দুজনের মৃত্যু – দৈনিক প্রথম আলো, ১৫ ফেব্রুয়ারি  ২০১৩

[প্রবন্ধটি sylhettoday24 এ  ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬ প্রকাশিত হয়েছিল]

মন্তব্যসমূহ
বই পড়তে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি' এ্যাপটি ব্যবহার করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button