বই-দলিলপত্র-প্রবন্ধমুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা ও প্রকাশনা কেন্দ্র
Trending

মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের চর্চা সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমাদের সবচেয়ে বড় অবলম্বন – সাব্বির হোসাইন

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৫০ বছর

বই পড়তে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি' এ্যাপটি ব্যবহার করুন।

১৬ ডিসেম্বর, ২০২১; মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০ বছর। অর্ধ-শতাব্দী আগে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয় পৃথিবীর বুকে বাঙালির একমাত্র স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের সূচনা হয়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, আত্মিক ঔপোনিবেশিক দাসত্ব থেকে মুক্তির লড়াই। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে বাঙালির অর্জিত সাংবিধানিক আর্দশ তথা ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সম্পদের সুষম বন্টন ও জাতি হিসেবে বাঙালির বিকাশ। আজ পঞ্চাশ বছর পরেও এই চার মূলনীতির আবেদন কমেনি বরং দুর্নীতি ও ধর্মীয় উগ্রবাদের অপছায়ায় আবর্তিত বর্তমানের অস্থির সময়ে এই চার মূলনীতির প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা বাঙালির মুক্তি ও বিকাশের একমাত্র চাবিকাঠি।

বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয়টি হলো, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে সূচনা হয় মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির তাঁবেদারদের প্রায় তিন দশকের শাসনামল। এই সময়ে বাংলাদেশে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত আদর্শধারীদের পুর্নবাসিত করা হয়; ফলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ভয়াবহ বিকৃতি সাধন করা সহ ভূলুন্ঠিত করা হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও জাতীয়জীবনে মানবিকতার চুড়ান্ত অবক্ষয় হয়, যার দুর্দশাময় পরিণতি আমরা এখনো ভোগ করছি।

কিন্তু শত প্রতিকূলতার মাঝেও আমরা বাঙালিরা হার মেনে নিইনি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড পরবর্তী প্রতিরোধ যুদ্ধ,নব্বই দশকের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, ৯২’র গণআদালত, ৯৬’র গণতন্ত্র আন্দোলন, ২০০৭-এর ছাত্রদের সেনা সমর্থিত সরকার বিরোধী আগস্ট আন্দোলন, ২০১৩-র শাহবাগ আন্দোলন বাঙালির অদম্য মানবিক মানসিকতা ও শক্তির প্রমাণ দেয়; শতপ্রতিকূলতার মাঝেও অন্যায়, অনাচারের বিরুদ্ধে বাঙালি বারবার জেগে উঠে ফিনিক্স পাখির মতো।

থার্ড লেন পত্রিকা’র প্রচ্ছদ থেকে নেয়া

বাংলাদেশের বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা দুর্নীতি, রাজনৈতিক ইসলামের উত্থান ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস।

বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। রাজনৈতিক ইসলামের উগ্র আগ্রাসনও নতুন নয়। দেশে শরিয়া আইন কায়েমের লক্ষ্যে ক্রমাগত ইসলামে অবিশ্বাসীদের উপর হামলা হচ্ছে। আদর্শগতভাবে সেকুলার আওয়ামীলীগও আজ এই মৌলবাদী শক্তির কাছে অসহায়।

রামু, নাসিরনগর, অভয়নগর, সাঁথিয়া, গুলশান হলি আর্টিজান, প্রগতিশীল লেখক-ব্লগার-একটিভিস্টদের উপর হামলা-খুনের মত মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা একের পর এক ঘটে গেছে। কিন্তু একটি ঘটনা থেকেও শিক্ষা নেওয়া হয়নি। রামু থেকে রুপসা, আজ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী হামলার ঘটনায় মামলা, গ্রেফতার হলেও সঠিক বিচার হয়নি একটিও। বরং সরকারি দল থেকে মনোনয়ন পেয়েছে হামলাকারীরা।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আট বছর ৯ মাসে হিন্দুদের ওপর ৩ হাজার ৬৭৯টি হামলা হয়েছে। এমনকি ২০২০ সালে করোনা মহামারীর মধ্যে সংখ্যালঘুদের ১১টি বাড়ি ও ৩টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার তথ্য রয়েছে আসকের প্রতিবেদনে। মন্দিরে হামলার ঘটনা হয়েছে ৬৭টি।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর হামলাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা কিংবা কেবলমাত্র রাজনৈতিক কারণ হিসাবে উপস্থাপনা করার অবকাশ আর নেই। জামাত-বিএনপি-হেফাজত সহ রাজনৈতিক ইসলামি গোষ্ঠী বাংলাদেশের মুসলমানদের মাঝে কট্টর মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়িয়ে দিয়েছে এবং এর শেকড় সর্বস্তরে ছড়িয়ে পরেছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় বিপুল সংখ্যক মানুষের সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়া থেকে এনিয়ে ধারণা পাওয়া যায়।

এবছর ২০২১ এ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে কেন্দ্র করে হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে সংঘটিত সারাদেশ জুড়ে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী কার্যকলাপের পর এই অক্টোবরে শারদীয় পূজার সময় ঘটেছে একযোগে দেশব্যাপী সংঘটিত সবচেয়ে বড় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা।

এই সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী ঘটনাগুলো পূর্বপরিকল্পিত, এটি নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

ঘটনাগুলো ঘটার সময় পুলিশের তৎপরতার বিরুদ্ধে ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য দেয় ইসলামি ঐক্যজোট, ইসলামি আন্দোলন, মুসলিম ঐক্যজোট, খেলাফত আন্দোলন, ছাত্র খেলাফত, হেফাজতে ইসলামের নেতারা। ঘটনাগুলোতে স্থানীয় মসজিদ ও মাদ্রাসা কমিটির দৃশ্যমান সম্পৃক্ততা ছিল। এরসাথে ছিল স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের আশ্চর্যরকম নীরবতা।

পুলিশ বাহিনী হস্তক্ষেপ না করলে ক্ষয়ক্ষতি আরো বাড়তে পারতো। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, দেশব্যাপী এরকম সিরিজ সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী হামলা-নাশকতার ছকের তথ্য কি করে গোয়েন্দা বাহিনী বা প্রশাসনের অজানা থাকে!!! কেন কুমিল্লার নানুয়ার দীঘির পাড়ের ঘটনার পর প্রশাসন দেশব্যাপী তড়িৎ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়নি? কেন তারা এই ঘটনায় নীরব ভূমিকা পালন করেছেন?

সুবর্ণজয়ন্তীতে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনার পর সন্ত্রাস দমন অভিযান চালানোর প্রেক্ষিতে সন্ত্রাসী সংগঠন হেফাজত ধরাশায়ী হলেও, রক্তাক্ত শারদের ঘটনায় স্পষ্ট এটি – ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামটিরই শুধুমাত্র ধরাশায়ী অবস্থা হয়েছে, পেছনের রূপকাররা বহাল তবিয়তেই আছে; সেই পুরোনো বিএনপি-জামাত-আইএসআই-হেফাজত চক্র।

যেকোন সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। সরকারি দল, প্রশাসন সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ঠেকানোর ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারে না। সরকার, প্রশাসনের জবাবদিহিতা প্রয়োজন, কি করে সারাদেশব্যাপী এরকম সন্ত্রাসী হামলা হয়? স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা খতিয়ে দেখা দরকার এবিষয়ে, জবাবদিহিতা প্রয়োজন।

মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এরকম সিরিজ সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা কেন সরকার প্রতিরোধ করতে পারছে না, কেন আন্তরিকতার অভাব; এসব খতিয়ে দেখতে হবে। সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা প্রতিরোধে যথাযথ আইন আছে কিনা, প্রশাসন দক্ষ কিনা এসব বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার বিষয় আছে।

বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির হচ্ছে…প্রতিটি ঘটনার পর সচেতন নাগরিকরা, নানান সংগঠন উদ্বেগ প্রকাশ করে। সরকার আশা দেয়, আমরা আশা-ভরসার মদ গিলে বুঁদ হয়ে থাকি। তারপর আবার সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। রীতিমত দু্ষ্টচক্রে পরিণত হয়েছে বিষয়টি। এই চক্রটি ভাঙা দরকার, নইলে সবই লবডঙ্কা।

সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনায় ‘তদন্ত, বিচার, সাজা’ নিশ্চিত করলে, তখন এসব সন্ত্রাসী ঘটনা কমে আসবে। সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসে জড়িতদের সনাক্ত করে এদের বিচার-সাজা নিশ্চিত করলে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা কমে আসবে। কিন্তু অন্যথা করলে, বিচার নিশ্চিত না করলে, এসব ঘটনা বন্ধ হবে না।

ষড়যন্ত্রকারী আর সাম্প্রদায়িক হামলাকারীদের প্রতিটি ঘটনাতে চিহ্নিত ও গ্রেফতারও করা হয়। কিন্তু তারপর? সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের জামিন-পুনর্বাসন, বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা…এই বিচার-বিলম্ব বন্ধ হলে, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের দুষ্টচক্র তখন ভেঙে যাবে।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় মৌলবাদীদের দমন, ধর্মনিরপেক্ষতা চর্চা, অসাম্প্রদায়িকতার শিক্ষার বিকাশের বিকল্প নেই। সরকারকে এবিষয়ে আন্তরিক হতে হবে, মূখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে।

অক্টোবরের রক্তাক্ত শারদের প্রতিবাদে চট্টগ্রামে সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমেছেন সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে, রংপুরে ছাত্রলীগ রাস্তায় নেমেছে, দেশের নানান জায়গায় হয়েছে প্রতিবাদ; এমন করে দেশের সব জায়গায় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে সর্বস্তরের মানুষকে সরব হতে হবে, সর্বস্তর থেকে প্রতিবাদ হওয়াটা জরুরি।

আমাদের মাঝে হতাশা, গ্লানি, ক্রোধের এক মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে কিন্তু আমরা থেমে যেতে পারি না; এই বাঙলা আমাদের শেষ ঠিকানা, আমাদের হাজার বছরের বসত; আমাদের বসতের অধিকার কেন ছেড়ে দেবো! মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হবে, নইলে যা কিছু অবশিষ্ট আছে, তাও আর আমাদের রইবে না, বাঙালির রইবে না। রাজাকারদের বিচার এই বাঙলার মাটিতে আমরা বাঙালিরা করেছি; আমরা পারবো এই সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদেরও রুখে দিতে।

অন্যায়ে চুপ করে থাকা আরো বড় অন্যায়। সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীরা কাউকে ছেড়ে দেবে না। আজ সরব না হলে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের একে একে সকলেই আফগানিস্তানের মত সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শিকার হবে।

সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের কাছে হার মানা যাবে না। সবাই যার যার অবস্থান থেকে সাধ্যমত প্রতিবাদ করতে হবে। মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা,সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে হার মানা যাবে না, জয় আমাদের হবেই, বাঙালির জয় হবেই।

আমাদের পূর্ব-পুরুষরা মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের বর্তমানকে উৎসর্গ করে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সম্পদের সুষম বন্টন, জাতি হিসেবে বাঙালির উন্নয়ন করার চেতনা থেকে সংবিধানের মূলনীতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাঁদের উত্তরসূরী হিসেবে আমাদের দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চর্চা ও প্রতিষ্ঠায় কাজ করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মৌলবাদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইয়ের পাথেয়, একমাত্র অস্ত্র। বিজয়ের অর্ধশতাব্দীতে আমরা নিজেদের কাছে এই প্রতিজ্ঞাটুকু করতে পারি।

জয় বাঙলা, জয় বঙ্গবন্ধু…

– সাব্বির হোসাইন
নভেম্বর ০৪, ২০২১
যুক্তরাষ্ট্র

মন্তব্যসমূহ
বই পড়তে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি' এ্যাপটি ব্যবহার করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button