বই-দলিলপত্র-প্রবন্ধসকল কনটেন্ট
Trending

১৯৭৫ সাল – সৈয়দ আলী আহসান

বই পড়তে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি' এ্যাপটি ব্যবহার করুন।

১৯৭৫ সাল

সৈয়দ আলী আহসান

READ

‘ ১৯৭৫ সাল ‘ অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানের দিনলিপি। ১৯৭৫ সালের ডায়েরি দেখেই আগ্রহ জেগেছিল। ‘৭৫ সালে সৈয়দ আলী আহসান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। পরে অবশ্য পদত্যাগ করেন। নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্যের ডায়েরির পাতায় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কী পাওয়া যায় তা জানতেই মূলত এই বইটি পড়া। আর, ১৯৭৫ বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম ঘটনাবহুল বছর। সে কারণে বাড়তি আগ্রহ তো ছিলই।

তৎকালীন সরকারি ছাত্রসংগঠন বনাম বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের বিবাদে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে, ছাত্রসংসদের বামপন্থী জিএস রোকনকে হত্যা করে সরকারদলীয় সংগঠনের ছেলেরা। তাতে মারামারি, খুনোখুনি চরম আকার ধারণ করে। উপাচার্য আলী আহসানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ। এদিকে পরীক্ষা ছাড়া ভর্তির কোনো সুযোগ না থাকলেও উপাচার্যকে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে কতিপয় ছাত্র। তাতে ইন্দন যোগায় বিশ্ববিদ্যালয়েররই রেজিস্টার। কারণ রেজিস্ট্রার সাহেব ছাত্রনেতাদের কাছে ভালো সাজতে চেয়েছিলেন।

১৯৭৫ সালের শুরুতেই আলী আহসান পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী একসময় সৈয়দ আলী আহসানেরই ছাত্র ছিলেন৷ কিন্তু শিক্ষকের এই দুঃসময়ে বিশেষ কিছু করতে পারেন নি ইউসুফ আলী। উল্টো পদত্যাগের কথা শুনে বিব্রত হয়েছিলেন। নিজের পদত্যাগের ইস্যুতে সৈয়দ আলী আহসান আলাপ করলেন অধ্যাপক এ আর মল্লিকের সাথে৷ তিনি আলী আহসানের কথা শুনে বললেন,

‘ বঙ্গবন্ধু যাদের চাকরি দেন, তাদের পদত্যাগ করবার অধিকার দেন না। পছন্দ না হলে তিনি তাদের সরিয়ে দেন। ‘

ক্ষমতার নেশা বড় নেশা। রিহ্যাবে পাঠালেও সেই নেশা থেকে মুক্ত হওয়া যায় না। তাই পদত্যাগ করার পরে সৈয়দ সাহেবের বোধদয় হয়তো হলো। তিনি উপার্চার্যগিরি বাদ দিয়ে অন্য কোনো উঁচু পদে পোস্টিংয়ের জন্য লবিং চালাতে লাগলেন৷ চতুর্থ সংশোধনী ততদিনে পাশ হয়েছে। এম. মনসুর আলী তখন প্রধানমন্ত্রী। তার কাছেও গেলেন আলী আহসান। কিন্তু লাভ হলো না।

আলী আহসানের পদত্যাগের পর তড়িঘড়ি করে উপাচার্য নিয়োগ করা হয় ড. এনামুল হককে। ড. হক এবং সৈয়দ আলী আহসানের সম্পর্ক ছিল সাপে-নেউলে। এই অংশটা পড়ে পাঠক মজা পাবেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর প্রচুর গাছপালা আছে৷ আম,কাঁঠাল গাছের সংখ্যাও কম নয়। নয়া উপাচার্য এনামুল হক বিশ্ববিদ্যালয়ে এত কাঁঠাল গাছ গেছে চিন্তায় পড়ে গেলেন৷ তার ভয় তৈরি হলো, যদি কেউ গাছ কেটে নিয়ে যায়! তিনি কর্মচারীদের নির্দেশ দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো কাঁঠাল গাছ রং দিয়ে চিহ্ন দিয়ে গণনা করে রাখতে। ভিসির নির্দেশে সবাই লেগে গেল কাঁঠাল গাছ গোণায়। যাকে বলে কাঁঠালবৃক্ষশুমারি!

জাহাঙ্গীরনগর থেকে সৈয়দ আলী আহসান ফিরে গেলেন তার ভূতপূর্ব কর্মস্থল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন চবির উপাচার্য আবুল ফজল। আবুল ফজলেও বিশেষ সহ্য হতো না সৈয়দ সাহেবের। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পরিচালনায় আবুল ফজলের অদক্ষতার সমালোচনা করেছেন, নারাজ হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে আবুল ফজলের স্বজনপ্রীতির। জনাব আবুল ফজলের সাথে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক ভালো ছিল। ১৫ আগস্টের পর অস্থির হয়ে ওঠেন আবুল ফজল। তার পদ চলে যায় কীনা তা নিয়েও শঙ্কায় ছিলেন৷ একপর্যায়ে সৈয়দ আলী আহসান তাকে হজে যাওয়ার পরামর্শ দেন। জবাবে আবুল ফজল বলেছিলেন,

‘ আমি কি পাপ করেছি যে হজে যাব। ‘

পুরো ‘৭৫ সালের বেশিরভাগ সময় সৈয়দ আলী আহসান কাটিয়েছেন বিভিন্ন সেমিনারে যোগ দিয়ে। পাশের দেশ ভারতে গিয়েছেন এক সম্মেলনে। সেখানকার আয়োজন, পরিবেশ দেখে হঠাৎই হিন্দুধর্মে পৌত্তলিকতা ও হিন্দু পুরাণে যৌনতার বাড়াবাড়ির সমালোচনা করলেন। মজার ব্যাপার হলো সৈয়দ আলী আহসান নিজে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য বিশেষ করে, বৈষ্ণব সাহিত্যের এক পণ্ডিত ব্যক্তি। শিক্ষক হিসেবেও ক্লাসে বৈষ্ণব সাহিত্য পড়াতেন৷ তার কাব্য বরাবরই রাধাকৃষ্ণের লীলার প্রাধান্য ছিল। যাদের বৈষ্ণব সাহিত্য নিয়ে কিঞ্চিৎ পড়াশোনা আছে, তারা জানেন বৈষ্ণব সাহিত্যে যৌন আবেদনের কমতি নেই। নিজে কবিতা লেখেন রাধাকৃষ্ণ লীলার প্রভাবসম্বলিত। পড়ান মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য। অথচ তিনিই সমালোচনা করছেন হিন্দুধর্মে নানা কাহিনিতে যৌনতার বাড়াবাড়ি নিয়ে। ভণ্ডামি আর কাকে বলে!

ক্ষমতার আরশতলে সৈয়দ আলী আহসান সবসময়ই ছিলেন। আইয়ুবের আমলে তার আত্মজীবনী বাংলায় অনুবাদ করে আইয়ুবের সান্নিধ্য পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভোল পালটে বাঙালি জাতীয়তাবাদী হয়েছেন৷ ‘৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর মোশতাকের সহচর মাহবুবুল আলম চাষী তাকে ডেকে নিয়েছে মোশতাকের কাছে। মাহবুবুল আলম চাষীর নেতৃত্বে মিটিং বসেছে৷ বহু জ্ঞানপাপীর সাথে সৈয়দ আলী আহসানও হাজির। হঠাৎ চাষী ক্ষেপে উঠলো কবি রফিক আজাদের ওপর। কারণ সে কবিতায় লিখেছে ‘ ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র চিবিয়ে খাব৷ ‘ সৈয়দ আলী আহসান রফিক আজাদের কবিতাকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিল। সে বললো, এটা হলো বাজে কবিতা। উদাহরণ হিসেবে সৈয়দ সাহেব সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘ ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’ পঙক্তির কথা উল্লেখ করলো। চাষীকে জানালো, সুকান্ত ভট্টাচার্যের এই কবিতার মতো রফিক আজাদের কবিতাটিও একটি বাজে কবিতা। বুঝুন অবস্থা!

মোশতাক সৈয়দ আলী আহসানকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করে পাঠান। এরপর সে জিয়ার আমলে প্রতাপশালী ছিল, ছিল বিরাট বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী , এরশাদের আমলে সে এরশাদকে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠার ভার নিয়েছিল। হয়েছিল দেশের জাতীয় অধ্যাপক।
সৈয়দ আলী আহসান একটি গুরুত্বপূর্ণ সভার খবর দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মোশতাকের সভাপতিত্বে দেশের গুণীজ্ঞানীদের নিয়ে সভা বসে। সেই সভাতে শুধু বিশিষ্ট ভদ্রলোকের সৈয়দ আলী আহসানই উপস্থিত ছিলেন না, সুফিয়া কামাল আর কবীর চৌধুরীর মতো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সপক্ষের মানুষরাও অংশ নিয়েছিল!

বাকশাল নিয়েও খুচরো কিছু ঘটনা আছে। পড়তে পারেন৷

সৈয়দ আলী আহসান খুবই মজার ক্যারেক্টার। নিজেকে বড্ড ধার্মিক মনে করেন। কতটা শুদ্ধ তিনি তা তার আত্মকথা পড়লে বোঝা যায়। যেখানে নূরী, নীলাদের জয়জয়কার। ধার্মিক সৈয়দ আলী আহসানের সঙ্গে কবি আলী আহসানের মিল খুঁজে পাই না। মুক্তিযুদ্ধের সময় যিনি স্বাধীন বাংলার পক্ষে কাজ করেছিলেন, তাকেই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী হিসেবে দেখলে হিসাব মেলে না।

খুবই সাদামাটা ভাষায় দিনলিপি লিখেছেন সৈয়দ আলী আহসান। প্রতিদিনকার কাজে, লেখনীতে নিজেই হয়তো নিজের অজান্তে রেখে গেছেন দ্বান্দ্বিক ভূমিকার প্রমাণ।

(লিখেছেনঃ স্বাধীন প্রান্ত,;গুডরিডস)

মন্তব্যসমূহ
বই পড়তে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি' এ্যাপটি ব্যবহার করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button