বই-দলিলপত্র-প্রবন্ধসকল কনটেন্ট
Trending

যুক্তরাজ্য প্রবাসী ছাত্রসমাজ ও মুক্তিযুদ্ধ – বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী

বই পড়তে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি' এ্যাপটি ব্যবহার করুন।

যুক্তরাজ্য প্রবাসী ছাত্রসমাজ ও মুক্তিযুদ্ধ

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী

ডিসেম্বর ২৪, ২০১৯

দৈনিক জনকন্ঠ

১৯৭১-এর মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলেও এর প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয় তারও আগে। একাত্তরের শুরুতেই বাঙালী জাতি প্রণিধান করতে পারে যে, স্বাধীন বাংলাদেশ অপরিহার্য এবং এই স্বাধীনতা সময়ের ব্যাপার মাত্র। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর সবার মন থেকে দ্বিধা বা সংশয়ের ঘোর কেটে গিয়েছিল। কেননা বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের জন্য সবাইকে প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন। বলেছিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত সব বাঙালীই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন।

৭ মার্চের পর আমাদের কর্মকান্ডের ও স্লোগানের ধারা পরিবর্তিত হলো। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বাইরেও ব্রিটিশ রাজনীতিকদের লবিং করার প্রয়োজন দেখা দিল। এ ব্যাপারে দু’জন জ্যেষ্ঠ ব্যক্তির সহায়তা লাভ করেছি, যারা ছিলেন বিবিসির সেরাজুর রহমান (তিনি তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষেই ছিলেন, যদিও পরে বোল পাল্টে ছিলেন) এবং লেখক আবদুল মতিন সাহেব, যিনি একটি ব্রিটিশ সংস্থায় উচ্চ পদে চাকরিরত ছিলেন। তারা আমাদের Fact Sheets তৈরি করে দিতেন ব্রিটিশ রাজনীতিক এবং দূতাবাসগুলোয় পৌঁছানোর জন্য। প্রয়াত মতিন সাহেব বহু গ্রন্থের রচয়িতা এবং একজন মুজিব গবেষক ছিলেন।

২৬ মার্চ আমরা অন্যদিনের মতো ব্রিটিশ পার্লামেন্টে লবিং করছিলাম। বিকেলের দিকে সুলতান শরিফ সাহেব বললেন, দেশে গণহত্যা শুরু হয়ে গেছে। তাই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির দরজার সামনে আমাদের অনশন অবস্থান শুরু করতে হবে। শরিফ ভাইয়ের কথায় সাড়া দিয়ে আমি এবং আরেক ছাত্র আফরোজ আফগান চৌধুরী অনশন শুরু করলাম প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির সামনের ফুটপাথে। তখন সেখানে কোন নিরাপত্তা বেষ্টনী ছিল না। আর ফুটপাথটিও ছিল বেশ বিশালকায়। সেদিন বিকেলেই বহু ব্রিটিশ সাংবাদিক, রেডিও ও টেলিভিশন রিপোর্টাররা এসে আমাদের বক্তব্য নেয়। ছবি তোলে। সেই সন্ধ্যায়ই রেডিও-টিভি মারফত আমাদের অনশনের কথা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয় বাংলাদেশের ব্যাপক গণহত্যার সংবাদের পাশাপাশি। পরের দিন গার্ডিয়ান এবং ইকোনমিস্টসহ বহু পত্রিকায় আমাদের অনশনের ছবিসহ সংবাদ প্রচার হওয়ায় অনশনস্থলে গণহত্যার খবরে উত্তেজিত বাঙালীদের আগমনের ঢল নেমে যায়, শত শত বাঙালী এলেন শুধু লন্ডন নয়, বিলেতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। কারণ সে সময় সংগ্রামী বাঙালীদের জমায়েতের কোন জায়গা ছিল না। জায়গাটি পার্লামেন্টের কাছে হওয়ায় পার্লামেন্টের উভয় সভার সদস্যরা এসে আমাদের কথা শুনতেন। আসতেন বহু ব্রিটিশ এবং বাইরের সাংবাদিক। জায়গাটি পর্যটন এলাকায় হওয়ায় বহু বিদেশী এসে জানতে চাইতেন বাংলাদেশে কী হচ্ছে। কী আমাদের দাবি। আমরা বহু বৃহদাকার পোস্টার নিয়ে বসেছিলাম, যার মধ্যে লেখা ছিলÑ গণহত্যা বন্ধ কর, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দাও, পাকিস্তানকে সাহায্য দেয়া বন্ধ কর, আমাদের নেতা শেখ মুজিব ইত্যাদি। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ যথাÑ সুলতান শরিফ, মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জু, খন্দকার মোশাররফ, বুলবুল এবং এবিএম খায়রুল হক সর্বক্ষণ সেখান থেকে সাংবাদিক ও রাজনীতিকদের প্রশ্নের জবাব দিতেন।

যেসব বাঙালী আমাদের সাহস যোগাতে আসতেন, তাদের মধ্যে পাঠক চিনবেন এমন কজন হলেন এবিএম খায়রুল হক (পরে প্রধান বিচারপতি), সৈয়দ আমিরুল ইসলাম (পরে বিচারপতি), রোকনউদ্দিন মাহমুদ (পরে ব্যারিস্টার), আখতার ইমাম (পরে ব্যারিস্টার), আমিনুল হক (ব্যারিস্টার, বিএনপির সাবেক মন্ত্রী), এনামুল হক (পরে জাদুঘর প্রধান), জাকিউদ্দিন, আলো চৌধুরী, সুরাইয়া খানম (পরে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক), কবি গোলাম মোস্তফার নাতনি মঞ্জু মজিদ, বিবিসির সেরাজুর রহমান, কমল বোস, শ্যামল লোধ, রাজিউল হাসান রঞ্জু, ফজলে রাব্বি মাহমুদ (পরে ডক্টর), বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর ছেলে আবুল হাসান চৌধুরী কায়সার (পরে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী), লুলু বিলকিস বানু (পরে অধ্যক্ষ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ), মার্ক টালি, এমপি জন স্টোন হাউস, ব্রুস ডগলাস মেন, মাইকেল বার্নস, আর্থার বটমলি, পিটার শোর, লর্ড ব্রুকওয়ে এবং আরও অনেকে। আমাদের অনশনের গুরুত্বের ওপর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তার স্মরণিকা ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো’তে লিখেছেন, ‘আন্দোলনের একেবারের শুরুর দিকেই ডাউনিং স্ট্রিটের কাছে ছাত্রনেতা মানিক চৌধুরী ও আফরোজ আফগান অনশন ধর্মঘট করেন। পরে সকলের অনুরোধে তারা অনশন প্রত্যাহার করেন। যেদিন অনশন করেছিলেন, সেদিন সাংবাদিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এর ফলে বাংলাদেশে পাকিস্তানীদের নির্মমতার কথা আরও ব্যাপকভাবে বিশ^বাসীর কাছে প্রকাশে সহায়তা করেন।’ (পৃ. ৫৪)। মার্চেই বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনে পদার্পণ করার পরই বিশেষ করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা তাকে সংগ্রামের নেতৃত্ব নেয়ার জন্য আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সম্মত হলে তার নেতৃত্বে গঠিত হয় স্টিয়ারিং কমিটি। বিচারপতি চৌধুরী এ প্রসঙ্গে তার স্মরণিকা ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো’তে লিখেছেন, ‘ছাত্রনেতা মোশাররফ হোসেন, মানিক চৌধুরী, রাজিউল হাসান রঞ্জু এবং অন্যান্য ছাত্রনেতা আমি লন্ডনে পৌঁছানোর পরেই দেখা করেন।’ (পৃ. ১১)। তিনি ব্রিটিশ কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যে আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছে, তার সমন্বয় করার জন্য তখনও কোন অফিস স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। তাই ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটের অনশন ধর্মঘট স্থানটি ২৮ থেকে ৩১ মার্চ এই চারদিন আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল। এরপর আমরা রাস্তায় নামলাম। জয় বাংলা, বাংলাদেশের স্বীকৃতি চাই, মুজিব আমাদের নেতা, গণহত্যা বন্ধ কর ইত্যাদি ধ্বনিসহ রাস্তা প্রকম্পিত করে ব্রিটিশ জনগণের মন জয় করা, যাতে সফলতা ছিল শত ভাগ। ব্রিটিশ জনগণও তাদের সংসদ সদস্যদের ওপর চাপ প্রয়োগ শুরু করল আমাদের দাবির পক্ষে। এপ্রিলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সহায়তায় ‘এ্যাকশন বাংলাদেশ’ নামক একটি ব্রিটিশদের সংস্থার সৃৃষ্টি। ওই মাসের মাঝামাঝি সময়ে একদিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে ফোন করে ‘পিস নিউজ’ পত্রিকার সম্পাদক রজার মুডি জানালেন, তারা ক’জন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাংলাদেশের সমর্থনে একটি ব্রিটিশ সংস্থা গঠনের। আমাদের সহায়তা চাইলেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেদিন সন্ধ্যায় আমি, খন্দকার মোশাররফ এবং মাহমুদ এ রউফ পিস নিউজ অফিসে গিয়ে পেলাম সংসদ সদস্য মাইকেল বার্নস, পিএইচডি ছাত্র, ইয়ং লিবারেল নেতা পল কনেট এবং এক পিএইচ ছাত্রী মেরিয়েটা প্রকোপকে। তারা সবাই বাংলাদেশে চলমান গণহত্যায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বললেন, আন্দোলনকে অধিক বেগবান করার জন্য এখন প্রয়োজন একটি ব্রিটিশ সংস্থা সৃষ্টি করা। মেরিয়েটা জানালেন, তিনি তার প্রতিবেশী ফজলে হাসান আবেদের (ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা) কাছ থেকে গণহত্যার বিস্তারিত শুনে শঙ্কিত এবং ক্ষুব্ধ। সেই বৈঠকেই সৃষ্টি হলো ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর প্রতিষ্ঠাতা পল কনেটকে সভাপতি এবং মেরিয়েটাকে সাধারণ সম্পাদক করে। মেরিয়েটা উত্তর লন্ডনে তার বিশালকায় বাড়ির একটি তলা দিলেন ‘অ্যাকশন বাংলাদেশের’ অফিসের জন্য। তার গাড়িও দিলেন এবং ব্যক্তিগত পরিচর্যাকারী মিসেস ডিকে দিলেন অ্যাকশন বাংলাদেশের সাধারণ কাজের জন্য। ধীরে ধীরে বহু বাঙালী এ্যাকশন বাংলাদেশের কর্মকা-ে অংশ নিতে থাকেন। এ্যাকশন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশে এক নতুন মাত্রা যোগ হয় আন্দোলনে। ফজলে হাসান আবেদ সাহেবও এ্যাকশন বাংলাদেশের কর্মকা-ে অংশ নিতেন। এ্যাকশন বাংলাদেশের কর্মকা-গুলোর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ১ জুলাই এবং ১ আগস্ট ট্রাফালগার স্কয়ার র‌্যালি। ওই মাসেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বিলেতের শীর্ষ পত্রিকাগুলোয় দেশে পাকিস্তানী সৈন্যরা যে তা-ব চালাচ্ছে, এর বর্ণনা দিয়ে পূর্ণ পৃষ্ঠা বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে, যা পরবর্তী সময়ে বহুবার করা হয়।

১ জুলাই এ্যাকশন বাংলাদেশ ‘অপারেশন ওমেগা’ নামে একটি টিমকে খাদ্য ও ওষুধ সামগ্রীসহ সরাসরি বাংলাদেশে পাঠায় লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ার থেকে। টিমে পল কনেট ও তার স্ত্রী এলেন কনেটও ছিলেন। যশোর সীমান্তে দুজনকেই গ্রেফতার করা হয়। পলকে ছেড়ে দিলেও এলেনকে আটকে রেখেছিল। এলেন তখন অন্তঃসত্ত্বা। তার পেটের ওই সন্তান জন্ম নেয়ার পর নাম রাখা হয় পিটার উইলিয়াম মুজিব কনেট। পল এবং এলেন উভয়কে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।

ট্রাফালগার স্কয়ারের ১ জুলাইয়ের ওই অনুষ্ঠানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদসহ অন্যান্য সংগঠনের কয়েক শ’ সংগ্রামী উপস্থিত ছিলেন। ওইদিনের অনুষ্ঠানে পাকিস্তান দূতাবাসে দ্বিতীয় সচিব পদে কর্মরত মহিউদ্দিন আহমেদ আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে চলে আসেন। অবশ্য গোপনে তিনি শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন এবং গোপন তথ্য পাচার করতেন। অনুষ্ঠানে শ্রী বিমান মল্লিক বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকেট প্রকাশ করেন। এর আগে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ‘পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি’ নিয়ে আলোচনার পর একটি চার সদস্যের পার্লামেন্টারি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়, যার ধারাবাহিকতায় রেজিনাল্ড প্রেন্টিস, ব্রুস ডগলাস ম্যান, স্যার আর্থার বটমলি এবং টবি জোসেল পশ্চিমবঙ্গ রিফিউজি ক্যাম্প এবং ঢাকায় যান। ৪ জুলাই দেশে ফিরে তারা সংবাদ সম্মেলনে বললেন, পাকিস্তান গায়ের জোরে পূর্ববঙ্গকে ধরে রাখতে পারবে না বিধায় ইয়াহিয়ার উচিত শেখ মুজিবকে (বঙ্গবন্ধু) মুক্তি দিয়ে আলোচনা করা। তারা আরও বললেন, পাকিস্তানের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি অপরিহার্য। তাদের বক্তব্য ব্রিটিশ এবং বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলোয় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। ওই সংবাদ সম্মেলন আয়োজনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, এ্যাকশন বাংলাদেশসহ অন্যান্য সংগ্রাম পরিষদের বিশেষ ভূমিকা ছিল।

সেপ্টেম্বরে প্যারিসে আন্তর্জাতিক পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের বার্ষিক সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের ৭০০ সংসদ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ একটি প্রতিনিধি দল পাঠায়, যার সদস্যরা অংশগ্রহণকারীদের বাংলাদেশে গণহত্যার কথা ব্যক্ত করে এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের দাবি জানায়। অক্টোবরে ব্রাইটনে ব্রিটিশ শ্রমিক দলের বার্ষিক সম্মেলন হয়। ওই সম্মেলনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা শ্রমিক দলীয় সংসদ সদস্য এবং অন্যদের মধ্যে ব্যাপক প্রচার চালায়। স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়ক আজিজুল হক ভূঞার নেতৃত্বেও একটি প্রতিনিধি দল গিয়েছিল সেখানে। সম্মেলনে বিভিন্ন বক্তা গণহত্যা এবং বাংলার মাটিতে পাকিস্তান সৃষ্ট গণদুর্দশার কথা উল্লেখ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলেন। শরণার্থী সমস্যাও আলোচনায় আসে। দাবি ওঠে পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধ করার।

অক্টোবরে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল শ্রীমতী ইন্ধিরা গান্ধীর লন্ডন আগমন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের কয়েকটি দেশে যান বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায় এবং গণহত্যা বন্ধের দাবি উত্থাপনের জন্য। বিভিন্ন দেশ সফরের অংশ হিসেবে তিনি লন্ডন এসে পৌঁছেন, যা ছিল প্রবাসী বাঙালীদের কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। ৩১ অক্টোবর শ্রীমতি গান্ধী পিকাডেলি সার্কাসের কাছে কলিসিয়াম থিয়েটারে প্রবাসী বাঙালী এবং ভারতীয়দের উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে এ কথা পরিষ্কার করেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ভারত নিরলসভাবে কাজ করে যাবে। তার ভাষণ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়, ভারত শীঘ্রই কিছু একটা করবে। তিনি বলেন, তিনি এক আগ্নেয়গিরির ওপর বসে আছেন। তিনি এ কথাও বলেন, বাংলাদেশে চালানো হত্যাযজ্ঞ সভ্যতার ইতিহাসে বিরল। আরও বলেন, ভারত এভাবে আর নীরব দর্শকের ভূমিকায় বসে থাকতে পারে না। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, মহিলা পরিষদসহ অন্যান্য সংগ্রাম পরিষদ ওই সভার আয়োজনে ইন্ডিয়া লীগ এবং ভারতীয় দূতাবাসকে সাহায্য করে।

২৩ নবেম্বর পাকিস্তানে জরুরী অবস্থা ঘোষণা, ইন্ধিরা গান্ধীর বিশেষ ক্যাবিনেট সভা এবং সামরিক প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকে সতর্ক থাকার নির্দেশ থেকে দেশ শীঘ্রই স্বাধীন হবে- এই আন্দাজ পেয়ে আমরা যুক্তরাজ্য ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিই। সেই উদ্দেশ্যে খন্দকার মোশাররফের নেতৃত্বে এক সভায় সৈয়দ মোজাম্মেল আলীসহ (বর্তমানে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সহসভাপতি) ৫ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়। ওই মাসেই যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব স্টুডেন্টসের সভাপতি জেফ হেবিসের নেতৃত্বে সংস্থার সভায় বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধ এবং স্বীকৃতির দাবি তোলা হয়।

ডিসেম্বরে বিভিন্ন দূতাবাসে আমাদের লবিং করার মাত্রা বেড়ে যায়। ওই মাসের ৬ তারিখে ভারত এবং ভুটান কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের ঘটনা ব্রিটিশ পত্রপত্রিকায় বিশেষ শিরোনাম করে ছাপানো হয়। আনন্দের জোয়ার বইতে থাকে বাঙালীদের মধ্যে। আমরা ভারতীয় দূতাবাসে গিয়ে ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানাই ভারতের রাষ্ট্রদূত আপা ভাই পান্তকে।

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী সৈন্য আত্মসমর্পণ করলে বাঙালী মহলে আনন্দের জোয়ার নামে। সব বাঙালী নেমে আসে রাস্তায়। আতশবাজি ফোটে, আনন্দ মিছিল হয়। আমরা চলে যাই আমাদের অস্থায়ী মিশন এবং ভারতীয় দূতাবাসে। এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমর্থন যেমন অপরিহার্য ছিল, তেমনি অপরিহার্য ছিল আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে প্রবাসী বাঙালীদের নিরলস ভূমিকা, যে ভূমিকা তারা যথাযথ পালন করতে পেরেছিলেন।

লেখক : প্রবাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপীল বিভাগ

মন্তব্যসমূহ
বই পড়তে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি' এ্যাপটি ব্যবহার করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button