স্মৃতি : ১৯৭১ (সকল খন্ড)
সম্পাদনা রশীদ হায়দার
বাংলা একাডেমি
১৯৮৮-২০১৯
১৯৮৮ সালের ৬ নভেম্বর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল আমাকে বললেন, ‘এবারের ১৪ই ডিসেম্বর শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসে নতুন কিছু করা প্রয়োজন। মহাপরিচালক মহোদয়ের এই কথা বলার একটা মহৎ উদ্দেশ্য ছিল, যা আমি শুধু একা নই, আমার শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় সহকর্মীবৃন্দ এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের প্রত্যেক বাঙালিই বুঝতে পারেন, এইরকম একটি সংকলন গ্রন্থের প্রয়োজনীয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কী ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে চলেছে।
মুক্তিযুদ্ধের এই ঐতিহাসিক সংকলন প্রসঙ্গে আমার প্রথম সবিনয় নিবেদন— সম্পাদক হিসেবে আমার নাম মুদ্রিত হলেও আমি নিজেকে কখনোই ‘সম্পাদক’ বলতে চাই না; বলি, ‘সংগ্রাহক’। কারণ ১৯৮৮ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ১৩টি খণ্ডে যে তিন শতাধিক লেখা ছাপা হয়েছে, তার মধ্যে প্রকৃত লেখকের সংখ্যা ২০-২৫ জনের বেশি নয়, কিন্তু অবশিষ্ট লেখকবৃন্দ? অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এই ‘অলেখক’দের মধ্যে অনেক লেখকের লেখা পড়ে আমার চোখ ভিজে উঠেছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়েছে, মনে হয়েছে আমি অনেকেরই অন্তরে রক্তক্ষরণের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আমার নিজের ব্যাখ্যায়—যাঁরা কোনোদিন কলম ধরেননি, লেখালেখির ভান-ভণিতা জানেন না, তাঁরা লিখেছেন হৃদয়ের রক্ত দিয়ে।
এইসব রক্তাপ্লুত রচনা সহৃদয় পাঠককে মুহূর্তেই স্পর্শ করে যায়, আবেগপ্রবণ করে তোলে। যাঁদের অতি আপনজন শহিদ হয়েছেন, তাঁদের শূন্যতা, কষ্ট, হাহাকার, বঞ্চনা, অবহেলা সারা জীবনের সঙ্গী হয়ে আছে এবং থাকবে। আমি দৃঢ়তার সঙ্গেই বলতে চাই, এই দুঃসহ কথামালা সম্পাদনা করা সম্ভব নয় বলেই, মহাপরিচালক ড. কামালের পরামর্শ ও নির্দেশ অনুসারে আমি শুধু সচেষ্ট থেকেছি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে উল্লিখিত বুদ্ধিজীবী কবে, কোথায়, কার দ্বারা, কীভাবে শহিদ হয়েছেন, সেই তথ্যগুলিই যথাযথ রাখতে।
একটি ভিন্নধর্মী ও চরিত্রের সংকলনের চিন্তা ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালের মাথায় এল কেন? তাঁকে জিজ্ঞেসও করেছিলাম। জবাবে তিনি বললেন, “একটি বিশেষ দিনে কিছু বুদ্ধিজীবী কিছু সারগর্ভ কথা বলে যান, তার প্রভাব মানুষের মনে পড়ে সামান্যই। কিন্তু, বিশেষ করে লিখিত আকারে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের আপনজনেরা স্মৃতিচারণ করলে তার মধ্য থেকে শহিদ ব্যক্তিকে যেমন চেনা যাবে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের জন্যেও প্রয়োজনীয় গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হবে।”
“স্মৃতি : ১৯৭১” যে স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচারে সহায়ক হবে, এমন কথা বলেছেন আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক ইতিহাসবিদ ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুন ও আরো অনেকে। তাঁরা তাঁদের অভিজ্ঞতার আলোকে দেখতে পেয়েছিলেন এই সংকলনের ভবিষ্যৎ ও প্রয়োজনীয়তা। বিশেষ ট্রাইবুনালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকালে এই সংকলনগ্রন্থ সহায়ক প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।
বলা বাহুল্য, ১৯৮৮ সালের ১৪ই ডিসেম্বর স্মৃতি ১৯৭১-এর প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হওয়ার পর আক্ষরিক অর্থেই সাড়া পরে পাঠকবৃন্দের মধ্যে। আলোচনা, পর্যালোচনা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে নতুন আগ্রহ বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। অনেকেই মন্তব্য করেন স্মৃতি: ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক নতুন সংযোজন। স্বয়ং হেনা স্যারের মূল্যায়ন হচ্ছে, এই সংকলন অচিরেই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের একটি প্রামাণ্য দলিল হিসেবে গৃহীত হবে। যেহেতু তিনি ছিলেন ভবিষ্যতদ্রষ্টা, তাই তাঁর মূল্যায়ন বৃথা যায়নি। ১৯৮৮ সালের ১০ই ডিসেম্বরে ‘প্রসঙ্গ কথা’য় তিনি লিখেছেন “আগামী ডিসেম্বরে শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসের ১৭ বছর পূর্ণ হবে। অবরুদ্ধ দেশে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসরদের হাতে যাঁরা প্রাণ দিয়েছিলেন, তাঁদের কথা কি সবাই ভুলে গেছে? না। জননী, জায়া, সন্তান ও সহকর্মীদের চোখ এখনো অশ্রুতে ভিজে ওঠে যখন প্রতিবছর একটি বিশেষ দিন এসে দরজায় কড়া নাড়ে যেন সাদা রুমালে মুখ-ঢাকা নিষ্ঠুর ঘাতক।”
সেইসব ঘাতক এখনো আছে। পালটা আঘাত কবে করবে সেই সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে। মাঝে ‘স্মৃতি: ১৯৭১’ ৭ম (সপ্তম) খণ্ড প্রকাশের আগে একজন মহাপরিচালক ‘অনেক খণ্ডই তো হলো’ বলে কাজটিই বন্ধ করে দিতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু প্রজন্ম একাত্তরের অকুতোভয় সদস্যদের প্রবল চাপে ও প্রতিবাদে সেই মহাপরিচালক পরবর্তী বছরের জানুয়ারি মাসে খন্ডটি প্রকাশ করতে বাধ্য হন। এভাবেই ১৯৮৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত মোট ১৩টি খণ্ড প্রকাশিত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ২০০০ সালের পর পরিবর্তিত সরকার মুক্তিযুদ্ধের আরো অনেক বিষয়ের মতো ‘স্মৃতি : ১৯৭১’ -এর প্রকাশনাও বন্ধ করে দেন।
যেহেতু সঠিক ইতিহাস তার আপন গতিতে চলে, সেজন্যে যত বাধা-বিপত্তিই আসুক, মুক্তিযুদ্ধের মতো গৌরবময় বিষয়কে কখনোই ছাইচাপা দিয়ে বন্ধ করা যাবে না। তার বর্তমান প্রমাণ, ‘স্মৃতি: ১৯৭১’-এর অনেকগুলো খণ্ড এখনো দুষ্প্রাপ্য বলে পাঠক আমাকে ও একাডেমি কর্তৃপক্ষকে অনেক সময় অভিযোগ করেই জানতে চান- নিঃশেষিত খণ্ডগুলো কেন পাই না?
বাংলা একাডেমি ‘স্মৃতি: ১৯৭১’-এর ১৩ খণ্ড আলাদা আলাদা ভাবে প্রকাশ না করে চার খণ্ডে (প্রথম খণ্ডে পূর্বের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড, দ্বিতীয় খণ্ডে চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ খণ্ড, তৃতীয় খণ্ডে সপ্তম, অষ্টম ও নবম খণ্ড এবং চতুর্থ খণ্ডে দশম, একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড) প্রকাশের উদ্যোগ নেয়। এই উদ্যোগ গ্রহণের জন্য বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানকে ধন্যবাদ জানাই।
প্রসঙ্গত, প্রথম থেকে চতুর্থ প্রত্যেক খণ্ডের আদ্যোপান্ত দেশে দেওয়াসহ বানানের ধারাবাহিকতা রক্ষার কাজটি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে করে দিয়েছেন ছড়াকার ও সাংবাদিক ওয়াসিফ-এ-খোদা। ‘স্মৃতি:১৯৭১’-এর পৃষ্ঠা বিন্যাসের কাজ আন্তরিকতার সঙ্গে করেছেন প্রকাশনা সহকারী জনাব মোঃ মোবারক হোসেন। আর এই কর্মযজ্ঞ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সহৃদয় তত্ত্বাবধান করেছেন বাংলা একাডেমির গবেষণা, সংকলন এবং অভিধান ও বিশ্বকোষ বিভাগের পরিচালক প্রীতিভাজন মোবারক হোসেন। পুনর্মুদ্রণের কাজ সুসম্পন্ন হওয়ায় সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা।
– রশীদ হায়দার
১৯৮৮ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত একে একে এ বইয়ের ১৩টি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। ২০০০ সালে এ বইয়ের প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ১৩টি খণ্ডে সংকলিত হয়েছে তিন শতাধিক স্মৃতিকথা।
সেই ১৩টি খণ্ড নতুন করে আবার ৪টি খণ্ডে সংকলিত হয়েছে ২০১৭ থেকে ২০১৯-এ।