৭১’এর জেনোসাইড ও নির্যাতন আর্কাইভবই-দলিলপত্র-প্রবন্ধ
Trending

১৯৭১ যুদ্ধদিনের স্মৃতি – তাজুল মোহাম্মদ

বই পড়তে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি' এ্যাপটি ব্যবহার করুন।

১৯৭১ যুদ্ধদিনের স্মৃতি

তাজুল মোহাম্মদ

২০১৩

তাজুল মোহাম্মদ। আশির দশক থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়ান তিনি। উদ্দেশ্য একটাই। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তথ্য ও ইতিহাস তুলে আনা। এ নিয়ে তিনি করেছেন বিস্তর অনুসন্ধান। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ইতিমধ্যে অর্ধ শতাধিক গবেষণামূলক বই প্রকাশ করেছেন। ’৭১ এর রণাঙ্গনে যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন এই মানুষটি। মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক চারণ-গবেষক ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্য রচনার জন্য পেয়েছে ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার ২০১৫’।

তাজুল মোহাম্মদ বর্তমানে কানাডায় প্রবাস জীবন অতিবাহিত করছেন। তবে এসব গবেষণার জন্য হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ছুঁটে আসেন দেশে। তিনি তার কাজে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে এমন এমন তথ্য তুলে এনেছেন, যা আগে কেউ তুলে আনতে পারেননি। তার গবেষণায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হয়েছে সমৃদ্ধ।

একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে তাজুল মোহাম্মদ সিলেট অঞ্চলে তৃণমূল পর্যায়ের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। কাজ করতেন কৃষি বিভাগে। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ঘুরতেন গ্রামীণ জনপদে। মানুষের সঙ্গে কৃষি বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে জেনে নিতেন তাদের অবস্থা, সুখ-দুঃখের গল্প। ঘুরে ফিরে চলে আসত মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ। প্রতিটি গ্রামেই লোকজন দেখাত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার স্থান, গণকবর; গুলি খেয়েও বেঁচে যাওয়া অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে। শুনেছেন তাঁদের সেই বিভীষিকাময় সময়ের কথা। লেখালেখির তেমন কোনো অভ্যাস ছিল না তাজুল মোহাম্মদের। কিন্তু মানুষের মুখ থেকে বিভীষিকাময় সেই কাহিনীগুলো শুনে শুনে ভেতরে তাঁর রক্তক্ষরণ হতো। অথচ কিছুই করতে পারতেন না। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮০ সাল, কর্মজীবনের এ চার বছর এভাবেই কাটে।

তাজুল মোহাম্মদ নিজের দায় থেকে, চেতনা থেকে শুরু করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহের কাজ। গ্রামের পর গ্রাম হেঁটে বেড়াতে খরচ করেছেন নিজের স্বল্প বেতনের টাকার একটি অংশ। দিনে দিনে তিনি সৃষ্টি করেছেন তরুণ প্রজন্মের পথরেখা।

১৯৮০ সালের জুলাই মাস। সিলেটের বালাগঞ্জের বুরুঙ্গা গ্রামের ৮১ জন গণহত্যার শিকার হওয়া কাহিনীটি তিনি তাঁর মতো লিখে সিলেটের স্থানীয় পত্রিকা সাপ্তাহিক দেশবার্তায় পাঠিয়ে দিলেন। পরের সপ্তাহেই সেটি পত্রিকায় ছাপা হলো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের একটি গণহত্যার বিভীষিকাময় কাহিনী প্রথমবারের মতো মানুষ জানল। পত্রিকায় অসংখ্য চিঠি এলো। পত্রিকার সম্পাদক হিমাংশু শেখর ধর (ঝর্ণাবাবু) তাজুল মোহাম্মদকে খবর দিয়ে অফিসে আনলেন। দেখালেন মানুষের পাঠনো অসংখ্য চিঠি। বললেন, গণহত্যার আরও কাহিনী সংগ্রহ করে তাঁর পত্রিকায় লেখার জন্য।

তাজুল মোহাম্মদ বলেন, ‘বুরুঙ্গার গণহত্যায় শহীদ ৮১ জনের তালিকা, ধর্ষিতা মহিলাদের তালিকা ও গুলিবিদ্ধ লোকজনের তালিকা দেখে দুই-চারজন সুহৃদ এ রকম আরও কিছু স্থানের নাম দেন আমাকে। তখনো কিন্তু আমি ধারাবাহিক কোনো লেখা বা বই প্রকাশের চিন্তা করিনি। কিন্তু বিষয়টি আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। তাই বুরুঙ্গার আশপাশের আরও কিছু হত্যা-কাহিনী সংগ্রহ করার চেষ্টা করি। আস্তে আস্তে বেশ কিছু গবেষণামূলক তথ্য আমার হাতে আসে। তাই ঠিক করলাম, অন্তত বালাগঞ্জ থানার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক নিহত নিরস্ত্র-নিরপরাধ লোকজনের নাম-পরিচয়, তাঁদের হত্যা করার পেছনের কাহিনী, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত এ দেশের দালালদের পরিচয়, ধর্ষিত মা-বোনের সংখ্যা, তাঁদের নাম-পরিচয় ইত্যাদি খুঁজে বের করব। এর সঙ্গে আসবে হানাদার বাহিনীর গুলিতে আহত হয়ে বেঁচে থাকা বাঙালি সন্তান এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পরিচিতি। যেমন- লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি। পাকিস্তানি সামরিক জওয়ান এবং এ দেশীয় কুলাঙ্গার, আলবদর, রাজাকার, আল-শামসের কুকীর্তির কাহিনী।’

সেই অনুযায়ী সন্ধান করতে গিয়ে দেখলেন, তিনি যা আশা করেছিলেন, আসল ঘটনা এর চেয়ে অনেক ভয়ংকর।

এ নিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘কত ভয়াবহ ঘটনার সন্ধান পেয়েছি, তা লিখে শেষ করা যাবে না। এসবের মুখোমুখি হওয়ার সময় কখনো নিজের শরীর শিউরে উঠেছে। রক্ত হিম হয়ে এসেছে কতবার। কত বিধবা কিংবা শহীদ সন্তানের বুক ফাটা আহাজারিকালে অশ্রু বিসর্জন করেছি আমি। তবুও কাজ করেছি। সংগ্রহের কাজ চালিয়েছি দীর্ঘ ২৩ বছর। উদ্ধার করেছি পাঁচ হাজার শহীদের নাম-ঠিকানা, তাঁদের হত্যার কাহিনী, এসব হত্যার পেছনে বাঙালি কুলাঙ্গারদের ভূমিকা। এ সময়কালে আমি সন্ধান লাভ করেছি এক হাজার ১২৫ জন পঙ্গু লোকের, যাঁরা মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে লড়ে বেঁচে আছেন। শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন আরও দুই হাজার ৭২৩ জন। অগ্নিসংযোগের ঘটনা সংগ্রহ করেছি পাঁচ হাজার ১৪৮টি এবং লুটপাটের ঘটনা পাঁচ হাজার ২১৭টি। গণহত্যার তালিকায় ছিলেন ৯৩ জন মহিলা, ১০০ বুদ্ধিজীবী এবং ৫০ শিশু-কিশোর। দুই হাজার ১২৮ জন কন্যা-জায়া-জননীকে ইজ্জত দিতে হয়েছে পাকিস্তানি হায়েনাদের এবং তাদের বাঙালি বশংবদদের হাতে। কিন্তু এটা কোনো পূর্ণাঙ্গ তালিকা নয়। এ পর্যন্ত সংগৃহীত উপাত্ত মাত্র। আমার সংগ্রহের বাইরে এখনো রয়েছে সহস্র ঘটনা, হাজারো শহীদ এবং বীরাঙ্গনা, যাঁরা ক্ষোভ-দুঃখ-লজ্জায় নিজেদের কথা প্রকাশ করছেন না। আর নারী নির্যাতনের কয়েক হাজার ঘটনা সামাজিক কারণে প্রকাশ করিনি আমি।’

সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া থানার সাধনপুর গ্রামে জন্ম তাজুল মোহাম্মদের। শিক্ষা ও চাকরিজীবন বৃহত্তর সিলেটেই। ১৯৭১ এ দক্ষিণ কুলাউড়া সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি, কুলাউড়ায় ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃস্থানীয় অবস্থানে (৭৪-৭৭), সিলেট জেলা খেতমজুর সমিতির আহবায়ক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য (৮২-৯২), বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি সিলেট জেলা কমিটির সদস্য (৮৪-৯২), বালাগঞ্জ উদীচীর সহ-সভাপতি ও খেলাঘর সিলেট জেলা কমিটির সহ-সভাপতি ও দুটোরই জাতীয় পরিষদের সদস্য তিনি। তাজুল মোহাম্মদের নেতৃত্বে সফল খেতমজুর আন্দোলন হয়েছে সিলেটের এওলারটুক, চারখাই এবং বালাগঞ্জে। তাজুল বৃহত্তর সিলেট ইতিহাস প্রণয়ন পরিষদ প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যোক্তা। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে তাজুল মোহাম্মদ কুরিয়ার হিসেবে কাজ করেন।

তিনি যখন একাত্তরে পাক হানাদারদের ধ্বংসযজ্ঞের তথ্যচিত্র সংগ্রহের কাজ শুরু করেন তখন সময়টা ছিল বেশ প্রতিকূলে। উপেক্ষিত। স্বদেশের জন্য যাঁরা বুকের তাজা রক্তে ঢেলেছিলেন- তাদের নাম তখনো অজানা, লোশহর্ষক বর্ণনাও অলিখিত। গ্রামের ছেলে তাজুল মোহাম্মদ নিজের আরাম- আয়েশ ত্যাগ করে এবং বেতনের অংশ ব্যয় করেই মুক্তিযুদ্ধের অন্যরকম যুদ্ধ বা কলমযুদ্ধ শুরু করার গর্বিত অংশীদারই তিনি নন, পথিকৃতও। তার দেখানো পথ ধরেই পরবর্তীতে গবেষকরা নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কার করে যাচ্ছেন। তবে তার সেই এ গবেষণামূলক কাজ আজও নিজের অর্থায়নে চলছে। নেই কোন অনুদান বা কোন সহযোগিতা।

তাজুল মোহাম্মদ রচিত প্রায় সব বই মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক। মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ-সংগঠক, প্রত্যক্ষদর্শী, সহায়তাকারীদের বয়ানে গণহত্যা, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, আলবদর-রাজাকার-আল শামসের নারকীয় কর্মকাণ্ড, গবেষক হিসেবে নিজের তথ্য সংগ্রহের অভিজ্ঞতা, নিজে দেখা যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ইত্যাদি ঠাঁই পেয়েছে বইগুলোতে। আর ছয়-সাতটি বই মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলার নানা ঐতিহাসিক সংগ্রামে ও সমাজ-জীবনে ভূমিকা রাখা আলোকিত ব্যক্তিত্বের ওপর। সদ্য প্রয়াত তারামন বিবির ওপর ‘নারী মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি, বীরপ্রতীক’ শিরোনামে তাঁর লেখা একটি বই আছে।

বামপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী তাজুল মোহাম্মদের লেখালেখি শুরু আশির দশকের শুরুতে। রাষ্ট্রযন্ত্রের চরম বৈরিতা, স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের হুমকি, যাতায়াত ও আনুষঙ্গিক সুবিধাদির অপ্রতুলতা—এসবের মধ্যেও তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে, সাপ্তাহিক ‘সচিত্র সন্ধানী’তে ধারাবাহিকভাবে লিখতে শুরু করেন সিলেটের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে- ‘সিলেটে গণহত্যা’; যা পরে জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে। ‘সিলেটে গণহত্যা’ বইটি দিয়ে দেশজুড়ে পরিচিত হন লেখক তাজুল মোহাম্মদ। এরপর একটানা লিখে গেছেন।

চারণ-গবেষক তাজুল মোহাম্মদ ঘুরেছেন গ্রামে, জনপদে। মিশেছেন অসংখ্য মানুষের সঙ্গে। বাস্তবতা থেকে আহরণ করেছেন তথ্য। ১৯৮০ থেকে এ কাজ করে চলেছেন তিনি। ঘরে বসে বইপত্র, পত্র-পত্রিকা থেকে তথ্য আহরণ নয়, একেবারে উৎসের কাছাকাছি ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ। এর ভিত্তিতে রচিত হয়েছে তাঁর অনেকগুলো গ্রন্থ। ধীমান গবেষক তাজুল মোহাম্মদ তৃণমূল পর্যায়ে অতি শ্রমসাপেক্ষ তথ্যানুসন্ধানের কাজে রয়েছেন একনিষ্ঠভাবে ব্রতী। এ কাজগুলো করতে গিয়েই তাঁর জীবনে আসে হুমকি। বাধ্য হন ১৯৯৫ সালে প্রবাস জীবন বরণ করে নিতে। বর্তমানে তিনি কানাডার মন্ট্রিয়েল প্রবাসী।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধ নিয়ে ১৯৯৫ সালে, ইংল্যান্ডের টোয়েন্টি টোয়েন্টি টেলিভিশন নির্মিত আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রামাণ্যচিত্র ‘ওয়ার ক্রাইমস ফাইলে’ তাজুল মোহাম্মদের তৃণমূল গবেষণা তথ্যগুলো বিশেষভাবে সংযোজিত হয়। হাওয়ার্ড ব্রাডবার্ন এর পরিচালনায় ও রিপোর্টার ডেভিড বার্গম্যানের রিপোর্টিংয়ের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয় তথ্যচিত্রটি। ‘ওয়ার ক্রাইমস ফাইল’ টিমে তাজুল যুক্ত হন গবেষণা কাজে।

তিনি পরিকল্পিতভাবে কিছু শুরু করেননি বলে এক গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন তাজুল মোহাম্মদ। রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে প্রায় কিশোর বয়স থেকে এবং কর্মজীবনে বৃহত্তর সিলেটের নানান জায়গায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছে তাঁর। সেই সময় এবং ৭৫ পরবর্তীতে আত্মগোপনে থাকার সময় তিনি প্রত্যক্ষভাবে জানতে পারেন মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী ও স্থানীয় দোসরদের বর্বর সব কাহিনি, দেখতে পান সিলেট জুড়ে অসংখ্য বধ্যভূমি। তাঁর মনে হয়, এ তো একটি কুঁড়ি, দুটি পাতার নয় বরং অগুনতি বধ্যভূমির সমাহার এই সিলেট। তখন থেকে তিনি গণহত্যার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং সংগ্রহ করতে শুরু করেন নানা তথ্য-উপাত্ত।

৭ বছরের সংগৃহীত তথ্যের আলোকে রচিত হয় ‘সিলেটে গণহত্যা’ (১৯৮৯, ২০০৫)। আবার ৮৬ থেকে ৯২-এই ৬ বছরের গবেষণা অর্থাৎ মোট ১১ বছরের পরিশ্রমের ফসল আরও দুটি বই: ‘সিলেটে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মারক’ (১৯৯৭) ও ‘সিলেটের যুদ্ধকথা’ (১৯৯৯)। ওয়ার ক্রাইমস ফাইল টিমের জন্য তাঁর এক বছরের মাঠ গবেষণার ওপর ভিত্তি করে রচিত হয় দুটি গ্রন্থ: ‘যুদ্ধাপরাধীর খোঁজে নয় মাস’ (২০১২) ও ‘আলবদরের ডায়েরি’ (২০১১)।

তাজুল মোহাম্মদের আলাপচারিতায় জানা যায়, এক সময় সিলেট ছাড়িয়ে প্রায় পুরো বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর পদচারণা। উত্তরবঙ্গের মাঠ গবেষণার ওপর ভিত্তি করে রচিত হয় ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের খোঁজে – কুড়িগ্রাম’ (২০০৮), ‘নারী মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি বীর প্রতীক’ (২০১৮), মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত আলী ও তাঁর যুদ্ধ (২০১৬)।

লন্ডনের ইম্পেরিয়াল ওয়ার মিউজিয়ামের ওর্যাল হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের এক এসাইনমেন্টে তাজুল ইংল্যান্ডের লন্ডন, বার্মিংহাম, ম্যানচেস্টার, স্কটল্যান্ডের এডিনবরা, স্পেনের মাদ্রিদ ইত্যাদি এলাকায় বসবাসরত মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার নেন। সেগুলো সংরক্ষিত আছে সে মিউজিয়ামে। আর সেই তথ্যগুলো সংযোজিত হয় তার ‘আমাদের একাত্তর’ বইয়ে।
তাজুল নিজের তথ্য সংগ্রহের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন দুটি বই। এগুলো হলো ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের খোঁজে’ (২০০১) ও ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সন্ধানে’ (২০১৪)। ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সন্ধানে’র অধিকাংশ লেখাই ‘সিলেট কণ্ঠে’ ‘মুক্তিযুদ্ধের উপাত্ত সংগ্রহ’ কলামে ছাপা হয়।

সেকেন্ডারি রিসোর্সেসের ওপর ভিত্তি করে লিখেছেন দুটো বই। শিমুল ফোটার ১৬ দিন (২০০৮), মার্চ ১৯৭১ (২০০৭)। এ ছাড়া লিখেছেন, মেজর আবদুস সালেক চৌধুরী বীরউত্তম ও সালদা যুদ্ধ (২০১৮), বিভীষিকাময় একাত্তর (২০১৫), এমন বর্বরতা কখনো দেখেনি কেউ (২০১৮)।

স্বদেশি আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে বাংলার সব আন্দোলন-সংগ্রামে অবদান রাখা বৃহত্তর সিলেটের আলোকিত মানুষদের ওপর তাঁর লেখা বইগুলোর মধ্যে রয়েছে: ‘সোনার মলাট’ (১৯৯০), ‘বারীণ দত্ত ও সংগ্রামমুখর দিনগুলি’ (২০০৯), ‘গোপেশ মালাকার তাঁর জীবন ও সময়’ (২০১৩), ‘সূর্যমণি দেব জন্মশতবর্ষ শ্রদ্ধাঞ্জলি’ (২০১১, সম্পাদিত), ‘সংগ্রামী সাত নারী’ (২০০৯), ‘হেনা দাস জীবন নিবেদিত মুক্তির প্রয়াসে’ (২০০৯), ‘মৃত্যুঞ্জয়ী হিমাংশু শেখর ধর’ (সম্পাদিত, ২০০৬), ‘ড. মীজান রহমান ধ্রুব জ্যোতি তুমি অন্ধকারে’ (২০১৭), ‘প্রফেসর মোহাম্মদ আবদুল আজিজ সম্মাননা গ্রন্থ’ (সম্পাদিত, ২০১৩), ‘মৃত্যুহীন প্রাণ আজির উদ্দিন খান’ (২০০৮) ইত্যাদি।

বৃহত্তর সিলেটের সামগ্রিক আন্দোলন সংগ্রাম নিয়ে রচনা করেছেন ‘সিলেটের দুই শত বছরের আন্দোলন’ (১৯৯৫)। এই বইয়ের বেশ কিছুটা অংশ ‘প্রথম চা শ্রমিক আন্দোলন’ শিরোনামে ইংল্যান্ডের জেসিএসসি এবং ও লেভেলের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত।

ভাষা আন্দোলনে সিলেটের সম্পৃক্ততা নিয়ে রচনা করেছেন ‘ভাষা আন্দোলনে সিলেট’’ (১৯৯৪) ও ‘ভাষা সংগ্রামীদের কথা, বৃহত্তর সিলেট’ (২০১৭)।

সোনা মিয়াঃ এক তরুণের প্রতিকৃতি, ভাষা আন্দোলনে সিলেট, একাত্তরে সিলেটঃ স্মৃতিকথা, সিলেটের দুইশত বছরের আন্দোলন, একাত্তরের স্মৃতিগুচ্ছ, মুক্তিযুদ্ধ ও প্রবাসী বাঙালি সমাজ, মুক্তিযুদ্ধের গাথাঁ, হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধ দিনের কড়চা, আপন স্মৃতির ভুবনে জননেতা আব্দুল হামিদ, কানাডার চিঠি, জোবায়দা খাতুন চৌধুরী-সংগ্রামী নারীর জীবনালেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের খোঁজে কুড়িগ্রাম, আমাদের একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধের পূণ্যস্মৃতি, একজন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা মঈনুল ইসলাম চৌধুরী, পৃথিবীর পথে, আল বদরের ডায়েরী, গৌরবের যুদ্ধ, ওয়ারক্রাইমস, ফাইলের পরে সাগর পারের দেশে, যুদ্ধপরাধীর খোঁজে নয় মাস, কুরুক্ষেত্রেী সেনা ১৯৭১, ১৯৭১ যুদ্ধদিনের স্মৃতি, জানা অজানার পশ্চিমা জগৎ, সংগ্রামমুখর দিনগুলি, তারা মিয়ার সেকাল-একাল, প্রত্যক্ষদর্শী ভাষ্যে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত আলী ও তার যুদ্ধ, ভাষা সংগ্রামীদের কথা, রসময় মোহান্ত নিভৃতে নিসর্গ জ্যোতি, মেজর আব্দুস সালেক চৌধুরী বীর উত্তম ও সালদা যুদ্ধ, এমন বর্বরতা কখনো দেখেনি কেউ, হৃদয়ের একুল ওকুল, কমরেড আব্দুল মালিকঃ দুর্বাতলে ৭ দশকের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের ধুলিপথের চারণ তাজুল মোহাম্মদ সম্মাননা গ্রন্থ, রাজাকারের কর্মকাণ্ড, একাত্তরে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ রক্তে ভেজা মাটির সাক্ষ্য, যুদ্ধদের স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ, ব্যাঘ্রের খাচায় কালাতিপাত, স্মরণে বিস্মরণে যারা, কাছ থেকে দেখা আমেরিকা। (মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সিক্ত গর্বিত নাম ‘তাজুল মোহাম্মদ’ – মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ – একুশে টেলিভিশন – ৭ মার্চ ২০২০)

মন্তব্যসমূহ
বই পড়তে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি' এ্যাপটি ব্যবহার করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button