একাত্তরের জননী
রমা চৌধুরী (১৪ অক্টোবর, ১৯৪১ – ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮)
২০১০
.
একাত্তরের জননী রমা চৌধুরী – আলাউদ্দিন খোকন
দৈনিক প্রথম আলো / চট্টগ্রাম বন্ধুসভা / ১৫ ডিসেম্বর ২০১০
‘পাকিস্তানি বাহিনী আমাকে প্রাণে না মারলেও আমার আত্মার অপমৃত্যু ঘটিয়েছে, যার ফলে নেমে এসেছে জীবনে শোচনীয় পরিণতি। আমার দুটি মুক্তিপাগল অবোধ শিশুর সাধ-স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষাভরা জীবন কেড়ে নিয়েছে বাংলার মুক্তিসংগ্রাম। আমার কাঁধে ঝোলা, খালি পা ও দুঃসহ একাকিত্ব একাত্তরেরই অবদান।’
মুক্তিকামী বাংলার মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী একজন জননী, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদারের হাতে সন্তান-সম্ভ্রম-ভিটেমাটিহারা একজন সর্বংসহা। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনকারী সাহিত্যিক রমা চৌধুরীর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ একাত্তরের জননী থেকে উদ্ধৃত অংশটুকু নেওয়া।
মুক্তিযুদ্ধ তথা একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিস্তৃত ইতিহাস আজও পূর্ণাঙ্গরূপে রচিত হয়নি। আর হয়নি বলেই ৪০ বছর পরও মুক্তিসংগ্রামের অনেক অজানা অধ্যায়ের কথা আমরা জানতে পারি। আমরা জানতে পারি একজন রমা চৌধুরীর নিজের বয়ানে লেখা গ্রন্থ থেকে, যা তিনি নিজেই গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছেন।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদাররা তাঁর একমাত্র ভিটেটুকু পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। সেই পোড়া ভিটা, সেই পোড়া মাটির ঘর আজও তাঁর বাসগৃহ, যা এখন ‘দীপঙ্কর স্মৃতি অনাথালয়’ নামে একটি অনাথ আশ্রম হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় রত রমা চৌধুরী নিজেই।
রমা চৌধুরী ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার পোপাদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী স্নাতকোত্তর (এমএ) রমা চৌধুরী ১৯৬২ সালে কক্সবাজার বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে পূর্ণাঙ্গ কর্মজীবন শুরু করেন। পরে দীর্ঘ ১৬ বছর তিনি বিভিন্ন উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি তিন পুত্রসন্তানের জননী। থাকেন পৈতৃক ভিটা পোপাদিয়ায়। সন্তানদের বাবা স্ত্রী-পুত্রদের নিরাপত্তার চিন্তা না করেই ভারতে চলে গেলে বৃদ্ধ মা ও সন্তানদের নিয়ে অসহায় অবস্থায় দিন যাপন করছিলেন।
এমনি একদিন ১৩ মে সকালবেলা পাকিস্তানি হানাদাররা এসে চড়াও হয় তাঁর ঘরে। তাঁকে জোর করে নিয়ে যায় পাশের নির্জন ঘরে। হারান সম্ভ্রম। দুগ্ধপোষ্য সন্তান তখন তাঁর কোলে। সন্তানের মায়ায় আত্মহনন থেকে নিবৃত্ত থাকলেও মানসিক এক অসীম কষ্ট সেই থেকে বয়ে বেড়ান। সম্ভ্রম হারানোর পর তাদের হাত থেকে পালিয়ে পুকুরে নেমে যখন আত্মরক্ষার জন্য লুকিয়েছেন, তখন হানাদাররা গানপাউডার লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয় তাঁর ঘরবাড়িসহ যাবতীয় সহায়-সম্পদ।
ঘরবাড়িহীন বাকি আটটি মাস তাঁকে তিনটি শিশুসন্তান আর বৃদ্ধ মাকে নিয়ে জলে-জঙ্গলে লুকিয়ে বেড়াতে হয়েছে। রাতের বেলায় পোড়া ভিটায় এসে কোনোমতে পলিথিন বা খড়কুটো নিয়ে মাথায় আচ্ছাদন দিয়ে কাটিয়েছেন। রোদ-বৃষ্টি-শীতে এই করে আস্তে আস্তে নুয়ে পড়েছেন। শেষ দিকে এসে আর পারলেন না। দুটি সন্তান ছয় বছরের সাগর, চার বছরের টগর ঝরে পড়ল তাঁর কোল থেকে। সেই নিদারুণ কষ্ট, সেই নিদারুণ যন্ত্রণার কথা তিনি লিখেছেন একাত্তরের জননী গ্রন্থে। ‘জয় বাংলা, জয় বাংলা, রাজাকার চলে যা’ বলতে বলতে ফুসফুস প্রদাহে আক্রান্ত সাগর ঢলে পড়েছিল মৃত্যুর কোলে। এর দুই মাস পরেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় টগর।
রমা চৌধুরী আজ জীবনসায়াহ্নে। তাঁর জীবনের সবচেয়ে সুসময় কেড়ে নিয়েছে বাংলার মুক্তিসংগ্রাম। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন, তারপর সেখানেও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে চাকরি ছেড়েছেন। গ্রামে ঘুরে ঘুরে টিউশনি করে জীবন চালিয়েছেন অনেক বছর। আলসারে আক্রান্ত হয়ে পড়লে তা-ও ছাড়তে বাধ্য হন।
এরপর গত ২০ বছর ধরে লেখ্যবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। যদিও তাঁর লেখ্যবৃত্তির পেশা একেবারেই স্বনির্বাচিত এবং স্বতন্ত্র। তিনি প্রথমে একটি পাক্ষিক পত্রিকায় লিখতেন। বিনিময়ে সম্মানীর বদলে পত্রিকার পঞ্চাশটি কপি পেতেন। সেই পত্রিকা বিক্রি করেই চলত তাঁর জীবনজীবিকা।
পরে নিজেই নিজের লেখা বই প্রকাশ করে, সেই বই তিনি ফেরি করে বেড়ান পথে পথে পাঠকের কাছে। সেই পেশা এখনো বর্তমান। প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতা মিলিয়ে বর্তমানে তিনি নিজের ১৫টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, মুক্তির সংগ্রাম আজও শেষ হয়নি। তাই আজও তিনি তাঁর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর এই সংগ্রাম এক সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে।
.
চলে গেলেন রমা চৌধুরী
(দৈনিক প্রথম আলো / ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮)
‘একাত্তরের জননী’সহ ১৮টি গ্রন্থের লেখক, মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতনের শিকার নারী রমা চৌধুরী আর নেই। আজ সোমবার ভোররাত ৪টা ৪০ মিনিটে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।
রমা চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হাড়ের ব্যথাসহ নানা রোগে ভুগছিলেন। গত বছরের ডিসেম্বরে বাসায় পড়ে গিয়ে কোমর ভেঙে গিয়েছিল তাঁর। সেই থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। কয়েক দিন আগে অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়। গতকাল রাত ১০টায় তাঁকে সেখানে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, ভোররাত ৪টা ৪০ মিনিটে রমা চৌধুরীর লাইফ সাপোর্ট খুলে দেওয়া হয়। আজ চট্টগ্রাম শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বোয়ালখালীর গ্রামের বাড়িতে রমা চৌধুরীকে সমাহিত করা হবে।
রমা চৌধুরী ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন রমা চৌধুরী। তিনিই ছিলেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী স্নাতকোত্তর (এমএ)। ১৯৬২ সালে কক্সবাজার বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। দীর্ঘ ১৬ বছর তিনি বিভিন্ন উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি তিন পুত্রসন্তানের জননী ছিলেন। থাকতেন পৈতৃক ভিটা পোপাদিয়ায়। তাঁর স্বামী ভারতে চলে যান। ১৩ মে সকালে পাকিস্তানি সেনারা এসে চড়াও হয় তাঁর ঘরে। এ সময় দুগ্ধপোষ্য সন্তান ছিল তাঁর কোলে। এরপরও তাঁকে নির্যাতন করা হয়। পাকিস্তানি সেনারা গানপাউডার দিয়ে আগুন জ্বেলে পুড়িয়ে দেয় তাঁর ঘরবাড়ি। পুড়িয়ে দেয় তাঁর সব সম্পদ। নিজের নিদারুণ এই কষ্টের কথা তিনি লিখেছেন ‘একাত্তরের জননী’ গ্রন্থে।
জয়লাভের পর ২০ ডিসেম্বর তাঁর বড় ছেলে সাগর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এর ১ মাস ২৮ দিন পর মারা যায় আরেক ছেলে টগর। এরপর তিনি জুতা পরা বাদ দেন। পরে অনিয়মিতভাবে জুতা পরতেন তিনি। ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর আরেক ছেলে মারা গেলে পুত্রশোকে তিনি আর জুতা পায়ে দেননি। খালি পায়ে হেঁটে নিজের লেখা বই বিক্রি করে চলতেন এই নারী।
২০ বছর ধরে লেখ্যবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন রমা চৌধুরী। যদিও তাঁর লেখ্যবৃত্তির পেশা একেবারেই স্বনির্বাচিত ও স্বতন্ত্র। তিনি প্রথমে একটি পাক্ষিক পত্রিকায় লিখতেন। বিনিময়ে সম্মানীর বদলে পত্রিকার ৫০টি কপি পেতেন। সেই পত্রিকা বিক্রি করেই চলত তাঁর জীবন-জীবিকা। পরে নিজেই নিজের লেখা বই প্রকাশ করে বই ফেরি করতে শুরু করেন। প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতা মিলিয়ে বর্তমানে তিনি নিজের ১৫টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন।
runamosharof@gmail.com
বইটি এ্যাপে পড়তে হবে।
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.liberationwar.com.bd.mel