বই-দলিলপত্র-প্রবন্ধ
Trending

জেলহত্যা ১৯৭৫ – জাতীয় চারনেতা হত্যাকান্ড

বই পড়তে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি' এ্যাপটি ব্যবহার করুন।

বিবিসি বাংলা, প্রথম আলো, ডয়েচে ভ্যালে, ভয়েস অব আমেরিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট ও কলামের আলোকে ‘জেলহত্যা ১৯৭৫ – জাতীয় চারনেতা হত্যাকান্ড’ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।

ফিরে দেখা ৩ নভেম্বরঃ চার নেতা খুন হলেন কেন – মহিউদ্দিন আহমদ – প্রথম আলো – ০২ নভেম্বর ২০২০

পঁয়তাল্লিশ বছর পেরিয়ে গেছে। এখনো ধোঁয়াশা কাটেনি। পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বরের প্রথম প্রহরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিহত হয়েছিলেন শীর্ষ পর্যায়ের চারজন রাজনৈতিক নেতা—সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান। এ নিয়ে একটি মামলা হয়েছে। বিচারও হয়েছে। কিন্তু চূড়ান্ত ফয়সালা হয়নি।

এটা সত্য যে আদালতে সব বিষয় আলোচনায় আসে না। সব জট খোলে না। তদন্তকারী সংস্থা এবং আইনজীবীরা যেভাবে চান, মামলা সেভাবেই গড়ায়। আদালতের রায়ে ইতিহাসের উপাদান থাকলেও তা শেষ কথা নয়। ইতিহাসের সূত্র খোঁজা আদালতের কাজ নয়।

একটি প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসে—এই চারজন জাতীয় নেতাকে কেন হত্যা করা হলো? এ প্রসঙ্গে একটি সরল ব্যাখ্যা আছে যে বাংলাদেশকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্য তাঁদের হত্যা করা হয়েছিল। অর্থাৎ তাঁরা নেতৃত্বে ফিরে আসতে পারেন বা তাঁরা ভবিষ্যতে সরকার গঠন করতে পারেন—এ রকম একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। এটি তাঁদের প্রতিপক্ষ চায়নি। এ জন্য পথের কাঁটা সরানো হলো। এই চার নেতা দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন; মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁদের হাত ধরেই স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সরকারের পথচলা শুরু।

৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে অবধারিতভাবে উঠে আসে ১৫ আগস্টের কথা। ১৫ আগস্ট এক সামরিক অভ্যুত্থানে সপরিবার নিহত হয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর ভগ্নিপতি পানিসম্পদমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং ভাগনে বাকশালের অন্যতম সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মণি। বোঝা যায়, অভ্যুত্থানকারীদের টার্গেট ছিল একটি পরিবার।

আওয়ামী লীগের এই চার শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তার হলেন ২৩ আগস্ট। ১৫ আগস্টের পর আট দিন তাঁদের কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। তখন আওয়ামী লীগ ছিল পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়। ওই সময় ক্ষমতায় ছিল খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে একটি সরকার, যার মন্ত্রিসভার সব সদস্যই ছিলেন আওয়ামী লীগ তথা বাকশালের। এটা ছিল একটা আধা সামরিক সরকার। এর ওপর ছড়ি ঘোরাত অভ্যুত্থানকারী মেজর-ক্যাপ্টেনরা। ক্যান্টনমেন্টের সেনানেতৃত্ব এটিকে সমর্থন দিলেও বঙ্গভবনের ওপর তাদের পুরো কর্তৃত্ব ছিল না। যদিও বঙ্গভবন পাহারার দায়িত্বে ছিল ৪৬ ব্রিগেডের দুটি কোম্পানি, যার নেতৃত্বে ছিলেন কর্নেল শাফায়াত জামিল। তাঁর অধীন মেজর খন্দকার আবদুর রশিদ তাঁকে খুব একটা মান্য করতেন না বলে তিনি মনঃক্ষুণ্ন ছিলেন। তিনি সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন।

২৪ আগস্ট কে এম সফিউল্লাহকে সরিয়ে জিয়াউর রহমানকে নতুন সেনাপ্রধান করা হয়। সিজিএস খালেদ মোশাররফ আগের পদেই বহাল থাকেন। ১৫ আগস্ট নিয়ে তাঁদের কোনো আহাজারির সংবাদ জানা যায় না। চেইন অব কমান্ড তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে শাফায়াত জামিল তাঁর ব্রিগেড নিয়ে ২ নভেম্বর রাতে অভ্যুত্থান শুরু করেন। ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে বিমানবাহিনীকে না জড়ানোয় বিমানবাহিনীর অনেক কর্মকর্তার মন খারাপ হয়েছিল। এবার তাঁরা সুযোগটি হাতছাড়া করলেন না। ৩ নভেম্বর ভোরে তাঁদের কেউ কেউ আকাশে জঙ্গি বিমান উড়িয়ে অভ্যুত্থানে শরিক হন।

চেইন অব কমান্ড পুনরুদ্ধার তত্ত্বটি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। কেননা, শুরুতেই অভ্যুত্থানকারীরা চেইন অব কমান্ড ভাঙেন। তাঁরা সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করে খালেদ মোশাররফকে সেনাপ্রধান করতে চান। অভ্যুত্থানটি ১৫ আগস্ট-পরবর্তী সরকারের বিরুদ্ধেও ছিল না। তাঁরা মোশতাককে রাষ্ট্রপতি রেখেই খালেদ মোশাররফকে সেনাপ্রধান করার জন্য ৪৮ ঘণ্টা দেনদরবার করেন।

৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানের কোনো কোনো অংশগ্রহণকারী ও সমর্থক পরে প্রচার করেছেন যে তাঁরা ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থান ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ কিংবা বদলা নিতে চেয়েছেন। এ দাবি ধোপে টেকে না। ১৫ আগস্ট দেশের চালচিত্র পাল্টে যায়। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকারীরা ১৫ আগস্টের আগের অবস্থায় ফিরে যেতে চেয়েছেন—এটি বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। যদি থাকত, তাহলে তাঁরা একটা রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতেন। এ জন্য তাঁদের জেলে আটক চার নেতার দ্বারস্থ হতে হতো। কিন্তু চার নেতা তাঁদের পরিকল্পনার মধ্যে থাকা তো দূরের কথা, ফুটনোটেও ছিলেন না। ৩০ ঘণ্টা পরে তাঁরা জানতে পারেন যে চার নেতা জেলখানায় নিহত হয়েছেন। যাঁদের নিয়ে সরকার গঠন করা হবে, প্রথম কাজটিই হতো তাঁদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা এবং তাঁদের বঙ্গভবনে নিয়ে আসার তোড়জোড় করা। চার নেতার কথা তাঁদের মনেই হয়নি। নিহত নেতাদের নিয়ে তাঁদের কোনো মাথাব্যথা, আবেগ কিংবা আহাজারি দেখা যায়নি। তাঁদের স্বজনেরা দোয়েল চত্বরের কাছে তিন নেতার মাজার প্রাঙ্গণে তাঁদের কবর খোঁড়ার উদ্যোগ নিলে সেটি ভন্ডুল করে দেওয়া হয়।

মোশতাক খুবই চতুর। তিনি কালক্ষেপণ করছিলেন। তিনি সঙ্গে পেয়েছিলেন দুজন সিনিয়র কর্মকর্তাকে—তাঁর নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল (অব.) এম এ জি ওসমানী এবং চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে। তাঁদের উপস্থিতিতে একটা আপস-মীমাংসা হয়। ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের কুশীলবেরা ৩ নভেম্বর রাতে নিরাপদে দেশত্যাগ করেন। দুটি অভ্যুত্থানের কুশীলবেরা ছিলেন পরস্পরের দীর্ঘদিনের বন্ধু, সহযোদ্ধা এবং প্রতিবেশী। কেউ ‘গৃহযুদ্ধ’ চাননি।

মোশতাক ৫ নভেম্বর পদত্যাগ করেন। রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে স্পিকারের রাষ্ট্রপতি হওয়ার কথা। সংবিধানে এটাই বলা আছে। খালেদ-শাফায়াতরা স্পিকারকে না ডেকে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতি বানিয়ে তাঁকে দিয়ে দুটি কাণ্ড ঘটান। এক. জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত হয়। দুই. বিচারপতি সায়েম হন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। তিন বাহিনীর প্রধানকে বানানো হয় উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। আইয়ুব খান ও ইয়াহিয়া খানের পর বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সামরিক আইন প্রশাসকের পদ তৈরি হয়। ১৫ আগস্টের পর সামরিক আইন জারি হলেও মোশতাক সামরিক আইন প্রশাসক হননি। খালেদ-শাফায়াতের মডেলটি ছিল আইয়ুব-ইয়াহিয়ার আদলে একচ্ছত্র সেনাশাসন। তাঁদের মধ্যে আরেকটি মিল পাওয়া যায়। আইয়ুব, ইয়াহিয়া এবং খালেদের অভ্যুত্থান—তিনটিই ছিল ‘রক্তপাতহীন’।

তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, জেলে চার নেতাকে খুন করা হলো কেন? তাঁরা তো জেলে ছিলেন, খালেদ-শাফায়াতের পরিকল্পনায় তো তাঁরা ছিলেন না। তাহলে কি অন্য কোনো মহলের অন্য কোনো পরিকল্পনা ছিল? আমরা জানি ৪ নভেম্বর ঢাকায় বাকশালের ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্বে একটি মিছিল হয়েছিল। খালেদ মোশাররফের মা এবং ভাই এ মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন। মিছিলের আয়োজকেরা তখনো জানতেন না, জেলে চার নেতাকে খুন করা হয়েছে। কোন ভরসায় তাঁরা মিছিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন?

দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, জেলহত্যার আশঙ্কা বা পরিকল্পনার কথা কি খালেদ-শাফায়াতরা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি? সেনাবাহিনীর মধ্যস্তরের কর্মকর্তাদের দুটি গ্রুপের একটি ১৫ আগস্টে এবং অন্যটি ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল। তাদের পারস্পরিক সম্পর্কে বড় ধরনের টানাপোড়েনের খবর জানা যায় না। হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা হিসেবে মোশতাকের দিকে তর্জনী তুললেও সংশ্লিষ্ট অন্যদের সন্দেহের বাইরে রাখা যায় না।

জেলহত্যাকাণ্ড এখনো আমাদের তাড়া করে বেড়ায়। অনুকূল পরিবেশ পেলে এবং রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্যভান্ডার উন্মুক্ত হলে বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করা সম্ভব।

কখন এবং কেন জাতীয় চার নেতাকে হত্যার সিদ্ধান্ত? – আকবর হোসেন, বিবিসি বাংলা, ঢাকা ৩ নভেম্বর ২০১৬

বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ আজ জেল হত্যা দিবস পালন করেছে। ১৯৭৫ সালের এই দিনে তৎকালীন আওয়ামী লীগের চারজন সিনিয়র নেতা – সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে ঢাকার কারাগারে হত্যা করা হয়।

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের পরেই তখন এ চারজন নেতা ছিলেন দলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

শেখ মুজিবকে হত্যার প্রায় আড়াই মাস পরে কারাগারে এ চার নেতাকে কেন হত্যা করা হয়েছিল?

শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব তখন অনেকটা দিশেহারা।

চারজন সিনিয়র নেতাসহ অনেকেই কারাগারে এবং অনেকে আত্ন গোপনে ছিলেন। বাকি নেতারা প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্যে নতুন রাস্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদের সাথে সমঝোতা করেন। অনেকে আবার রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান।

তৎকালীন রাজনীতির বিশ্লেষক এবং গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ মনে করেন জেল হত্যাকাণ্ডের সাথে ৩রা নভেম্বর মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কিত। কারণ মুজিব হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা ভেবেছিলেন খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে সে অভ্যুত্থান আওয়ামী লীগ বা বাকশালের পক্ষে হচ্ছে।

কিন্তু খালেদ মোশাররফ এবং তার সমর্থকদের কার্যকলাপ থেকে এ ধরনের কোন প্রমান পাওয়া যায়নি বলে মি: আহমেদ উল্লেখ করেন।

মি: আহমেদ বলেন , “ক্ষমতাসীন মোশতাক বা তার সমর্থকরা চাননি যে তাদের বিরোধী আরেকটি শক্তি শাসন ক্ষমতায় পুনর্বহাল হোক। ঐ ধরনের একটা সরকার যদি হতো তাহলে জেলে থাকা সে চারজন ছিলেন সম্ভাব্য নেতা।” তিনি বলেন এ সম্ভাবনা থেকে জেল হত্যাকাণ্ড হতে পারে।

পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর থেকেই হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা পাল্টা আরেকটি অভ্যুত্থানের আশংকায় ছিল।

সেনাবাহিনীর মধ্যে ছিল এক ধরনের বিশৃঙ্খলা। সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিল ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। একদিকে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং অন্যদিকে মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফ।

তখন ঢাকা সেনানিবাসে মেজর পদমর্যাদায় কর্মরত ছিলেন বর্তমানে বিগ্রেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি এসব ঘটনা প্রবাহ বেশ কাছ থেকে দেখেছেন। তার সে অভিজ্ঞতা নিয়ে মি: হোসেন একটি বই লিখেছেন ‘বাংলাদেশ রক্তাক্ত অধ্যায়: ১৯৭৫-৮১’ শিরোনামে।

শেখ মুজিবকে হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা তখন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহেমদকে পরিচালনা করছিলেন। মি: হোসেন বলেন বঙ্গভবনের থাকা সেনা কর্মকর্তাদের সাথে একটা সংঘাত চলছিল সেনানিবাসের উর্ধ্বতন কিছু সেনা কর্মকর্তাদের সাথে।

মি: হোসেন বলেন, ” খন্দকার মোশতাক যে বেশিদিন ওখানে টিকবেন না, এটাও ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে একটা ধারণা জন্মেছিল। তখন আবার সিনিয়র অফিসারদের মধ্যেও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছিল।”

শেখ মুজিবকে হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা ধারনা করেছিলেন যে কোন পাল্টা অভ্যুত্থান হলে সেটি আওয়ামী লীগের সমর্থন পাবে। সে ধরনের পরিস্থিতি হলে কী করতে হবে সে বিষয়ে মুজিব হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা কিছুটা ভেবেও রেখেছিলেন।

মি: হোসেন বলেন, “ঐ ধরনের ক্যু হলে তখনকার আওয়ামী লীগে যাতে কোন ধরনের লিডারশিপ না থাকে সেটাই তারা বোধ হয় নিশ্চিত করেছিল।”

হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা ভেবেছিল যদি সে চারজন রাজনীতিবিদকে যদি হত্যা করা হয় তাহলে পাল্টা অভ্যুত্থান হলেও সেটি রাজনৈতিক সমর্থন পাবেনা।

খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান যে আওয়ামী লীগের সমর্থনে হবে এমন ধারনা সঠিক ছিলনা বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা।

কিন্তু তারপরেও সে ধারনার ভিত্তিতে তৎকালীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় চারজন নেতাদের হত্যা করা হয় বলে বিশ্লেষকরা বলছেন।

যদিও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে যে অভ্যুত্থান হয়েছিল সেটির সাথে আওয়ামী লীগের কোন সম্পর্ক বা সমর্থনের বিষয়টি পরিষ্কার নয়।

১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর কারাগারের ভেতর জাতীয় চার নেতা তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানকে যেভাবে খুন করা হয় – বিবিসি বাংলা, ৩ নভেম্বর ২০১৭

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে একটি পিকআপ এসে থামে।

তখন রাত আনুমানিক দেড়টা থেকে দুইটা।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় সে গাড়িতে কয়েকজন সেনা সদস্য ছিল।

ঢাকা তখন এখন অস্থিরতার নগরী। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে অভ্যুত্থান এবং পাল্টা অভ্যুত্থান নিয়ে নানা রকম কথা শোনা যাচ্ছে তখন।

সে সময় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জেলার হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমিনুর রহমান।

রাত দেড়টার দিকে কারা মহাপরিদর্শক টেলিফোন করে জেলার মি. রহমানকে তাৎক্ষনিকভাবে আসতে বলেন।

দ্রুত কারাগারের মূল ফটকে গিয়ে মি. রহমান দেখলেন, একটি পিকআপে কয়েকজন সেনা সদস্য সশস্ত্র অবস্থায় আছে।

মূল ফটকের সামনে সেনা সদস্যরা কারা মহাপরিদর্শককে একটি কাগজ দিলেন।

সেখানে কী লেখা ছিল সেটি অবশ্য জানতে পারেননি মি. রহমান।

মূল ফটক দিয়ে ঢুকে বাম দিকেই ছিল জেলার আমিনুর রহমানের কক্ষ। তখন সেখানকার টেলিফোনটি বেজে উঠে।

মি. রহমান যখন টেলিফোনের রিসিভারটি তুললেন, তখন অপর প্রান্ত থেকে বলা হলো প্রেসিডেন্ট কথা বলবেন।

২০১০ সালে বিবিসি বাংলার কাছে সে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মি. রহমান বলেন, “টেলিফোনে বলা হলো প্রেসিডেন্ট কথা বলবে আইজি সাহেবের সাথে। তখন আমি দৌড়ে গিয়ে আইজি সাহেবকে খবর দিলাম। কথা শেষে আইজি সাহেব বললেন যে প্রেসিডেন্ট সাহেব ফোনে বলছে আর্মি অফিসাররা যা চায়, সেটা তোমরা কর।”

মূল ফটকের সামনে কথাবার্তার চলতে থাকে। এক সময় রাত তিনটা বেজে যায়।

আমিনুর রহমান বলেন, এক পর্যায়ে কারাগারে থাকা তৎকালীন আওয়ামী লীগের চার জন নেতাকে একত্রিত করার আদেশ আসে।

কারা মহাপরিদর্শক একটি কাগজে চার ব্যক্তির নাম লিখে জেলার আমিনুর রহমানকে দিলেন।

সে চারজন হলেন – সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামান।

আমিনুর রহমানের বর্ণনা অনুযায়ী সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দীন আহমদ কারাগারের একটি কক্ষে ছিলেন।

ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে অপর কক্ষ থেকে এখানে নিয়ে আসা হয়।

সেখানে আসার আগে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী কাপড় পাল্টে নিলেন।

মি. রহমানের বর্ণনা করেন, “তাজউদ্দীন সাহেব তখন কোরআন শরীফ পড়ছিলেন। ওনারা কেউ আমাদের জিজ্ঞেস করলেন না আমাদের কোথায় নেও (নেয়া হচ্ছে)? সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব হাত-মুখ ধুলেন। আমি বললাম আর্মি আসছে।”

চারজনকে যখন একটি কক্ষে একত্রিত করার ক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগার কারণে সেনাসদস্যরা কারা কর্মকর্তাদের নোংরা ভাষায় গালিগালাজ করছিল, বলছিলেন মি. রহমান।

“মনসুর আলি সাহেব বসা ছিল সর্ব দক্ষিণে। যতদূর আমার মনে পড়ে। আমি মনসুর আলীর ‘ম’ কথাটা উচ্চারণ করতে পারি নাই, সঙ্গে সঙ্গে গুলি,” বলেন মি. রহমান।

কারাগারের ভেতর এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের খবর চার নেতার পরিবার সেদিন জানতে পারেননি।

তাজউদ্দীন আহমদের পরিবার কারাগারের খোঁজ নেবার জন্য সারাদিন চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন।

পরের দিন অর্থাৎ ৪ নভেম্বর পুরনো ঢাকার এক বাসিন্দা তাজউদ্দীন আহমদের বাসায় এসে জানান যে তিনি আগের দিন ভোরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গুলির শব্দ শুনেছেন।

প্রয়াত তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে সিমিন হোসেন রিমি ২০১০ সালে বিবিসি বাংলাকে বলেন, ৪ নভেম্বর বিকেল চারটার দিকে খবর আসতে শুরু করলো তাজউদ্দীন আহমদসহ চারজন নেতাকে হত্যা করা হয়েছে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমানকে প্রায় সপরিবারে হত্যার ঘটনার সাথে জেল হত্যাকাণ্ডের যোগসূত্র আছে বলে মনে করা হয়।

তখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে লে. কর্নেল হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমিন আহমেদ চৌধুরী, যিনি পরবর্তীতে মেজর জেনারেল হয়েছিলেন। কয়েক বছর আগে মারা গেছেন মি. চৌধুরী।

২০১০ সালে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, তখন সেনাবাহিনীতে নেতৃত্ব নিয়ে টানাপোড়েনের পরিণতি ছিল জেলখানার হত্যাকাণ্ড।

১৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানের বিপরীতে পাল্টা আরেকটি অভ্যুত্থান হয়েছিল তেসরা নভেম্বর।

সেটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ।

আমিন আহমেদ চৌধুরীর মতে, তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থানটি ছিল অনিবার্য।

কারণ শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছয়জন জুনিয়র সেনা কর্মকর্তা তখন বঙ্গভবনে বসে রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাককে পরিচালনা করছিলেন।

শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছয়জন জুনিয়র সামরিক কর্মকর্তাকে সেনাবাহিনীর চেইন অব কমাণ্ডের আওতায় আনার জন্য তেসরা নভেম্বর খালেদ মোশারফের নেতৃত্ব অভ্যুত্থান হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন জেনারেল চৌধুরী।

তাছাড়া শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডকেও তাঁরা মেনে নিতে পারছিলেন না বলে তিনি উল্লেখ করেন।

কিন্তু খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে সে অভ্যুত্থান সেনাবাহিনীর ভেতরে আবারো চেইন অব কমাণ্ড ভাঙার সম্ভাবনা তৈরি করেছিল বলে মনে করেন জেনারেল চৌধুরী।

খালেদ মোশারফের অনুগত সৈন্যরা বন্দি করে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে।

ঢাকা সেনানিবাসে যখন এ অবস্থা চলছিল সে সময় পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে জেলখানায় আওয়ামী লীগের চারজন সিনিয়র নেতাকে হত্যা করা হয়।

পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর থেকেই হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা পাল্টা আরেকটি অভ্যুত্থানের আশংকায় ছিল।

সেনাবাহিনীর মধ্যে ছিল এক ধরনের বিশৃঙ্খলা। সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিল ক্ষমতার দ্বন্দ্ব।

একদিকে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং অন্যদিকে মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফ।

তখন ঢাকা সেনানিবাসে মেজর পদমর্যাদায় কর্মরত ছিলেন বর্তমানে বিগ্রেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন।

তিনি এসব ঘটনাপ্রবাহ বেশ কাছ থেকে দেখেছেন। তার সে অভিজ্ঞতা নিয়ে মি. হোসেন একটি বই লিখেছেন ‘বাংলাদেশ রক্তাক্ত অধ্যায়: ১৯৭৫-৮১’ শিরোনামে।

শেখ মুজিবকে হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা তখন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদকে পরিচালনা করছিলেন।

ব্রিগেডিয়ার হোসেন বলেন, বঙ্গভবনের থাকা সেনা কর্মকর্তাদের সাথে একটা সংঘাত চলছিল সেনানিবাসের উর্ধ্বতন কিছু সেনা কর্মকর্তাদের সাথে।

“খন্দকার মোশতাক যে বেশিদিন ওখানে টিকবেন না, এটাও ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে একটা ধারণা জন্মেছিল। তখন আবার সিনিয়র অফিসারদের মধ্যেও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছিল,” বলছিলেন ব্রিগেডিয়ার হোসেন।

শেখ মুজিবকে হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা ধারনা করেছিলেন যে কোন পাল্টা অভ্যুত্থান হলে সেটি আওয়ামী লীগের সমর্থন পাবে। সে ধরনের পরিস্থিতি হলে কী করতে হবে সে বিষয়ে মুজিব হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা কিছুটা ভেবেও রেখেছিলেন।

তিনি বলেন, “ঐ ধরনের ক্যু হলে তখনকার আওয়ামী লীগে যাতে কোন ধরনের লিডারশিপ না থাকে সেটাই তারা বোধ হয় নিশ্চিত করেছিল।”

হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা ভেবেছিল যদি সে চারজন রাজনীতিবিদকে যদি হত্যা করা হয় তাহলে পাল্টা অভ্যুত্থান হলেও সেটি রাজনৈতিক সমর্থন পাবে না।

জেলহত্যা: চারজন রাজনীতিককে হত্যার ঘটনা তাদের পরিবারের সদস্যরা কখন কীভাবে জেনেছিলেন – কাদির কল্লোল – বিবিসি বাংলা ঢাকা – ৩ নভেম্বর ২০২২

আওয়ামী লীগের চারজন সিনিয়র রাজনীতিককে হত্যার পর ৪৭ বছর পেরিয়ে গেছে । ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল ঢাকার কারাগারে।

তৎকালীন আওয়ামী লীগের চারজন সিনিয়র নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে হত্যা করা হয়েছিল ।

দিনটি এখন জেল হত্যা দিবস হিসাবে পালিত হয়।

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব যখন অনেকটা দিশেহারা, সে সময় দলের গুরুত্বপূর্ণ এই চার নেতাসহ অনেককে বন্দি করা হয়েছিল।

ঢাকার কারাগারে ঐ চার রাজনৈতিক নেতার হত্যাকাণ্ড নিয়ে সেদিন নানা গুজব ছড়িয়েছে দিনভর। তাদের পরিবারের সদস্যদের দিনটি কেটেছে শঙ্কা আর উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে।

কারাগারে পাগলাঘণ্টা বেজেছিল ভোরে এবং কিছু একটা ঘটেছে সেখানে- এ ধরনের নানা খবর আসছিল পরিবারগুলোর কাছে।

পরিবারগুলোর সদস্যদের অনেকে ছুটে গেছেন কারাগারের সামনে, কিন্তু সেই ৩রা নভেম্বর হত্যাকাণ্ডের নিশ্চিত কোন খবর তারা জানতে পারেননি।

তাজউদ্দীনের পরিবার যেভাবে জানতে পারে

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী মুজিবনগর সরকারে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ।

জেলাখানায় যে চারজনকে হত্যা করা হয়, তাদের একজন মি: আহমদ।

তিনি ঢাকার ধানমন্ডিতে সাত মসজিদ রোডের বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বসবাস করতেন। সেই বাড়ি থেকেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর ২২শে অগাষ্ট।

তাজউদ্দীন আহমদকে হত্যার ঘটনার পরদিন ৪ঠা নভেম্বর সেই খবর জানতে পেরেছিল তাঁর পরিবার ।

মি: আহমদের বড় মেয়ে সিমিন হোসেন রিমি তখন নবম শ্রেণিতে পড়তেন। তিনি এখন আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় সংসদের একজন সদস্য।

৭৫ এর ৩রা নভেম্বর সারাদিনের উৎকণ্ঠা এবং পরদিন হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া, সবকিছুই সিমিন হোসেন রিমির স্মৃতিতে রয়েছে।

তিনি জানিয়েছেন, জেলে হত্যার ঘটনার আগের রাতে সাত মসজিদ রোডের বাড়িতে এক বিছানায় ঘুমিয়েছিলেন তিনি এবং তাঁর মা আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন। তাঁর বাকি দুই বোন ও এক ভাই ছিলেন অন্য ঘরে।

হত্যাকাণ্ডের দিনে ৩রা নভেম্বর ভোরে যুদ্ধ বিমানের শব্দে তাঁদের ঘুম ভেঙে যায়। তখন তাঁর মা বিচলিত হয়ে বার বার বলছিলেন, জেলখানায় কিছু ঘটলো কীনা? কারণ তাজউদ্দীন আহমদ গ্রেফতার হওয়ার পর জোহরা তাজউদ্দীন দেখা করতে গেলে মি: আহমদ তাঁকে হত্যা করা হতে পারে-এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।

কিন্তু তারা বাইরে কোনো খোঁজ খবর নিতে পারছিলেন না। কারণ তাদের বাসার টেলিফোন লাইন কেটে দেয়া হয়েছিল ৭৫ এর ১৫ই অগাষ্ট শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর। এছাড়া তাদের ওপর নজরদারী ছিল।

সিমিন হোসেন রিমি বলেছেন, ৩রা নভেম্বর সারাদিন তাদের কেটে যায় নানা গুজবে । কিন্তু কিছুই জানতে পারেননি।

পরদিন ৪ঠা নভেম্বর সকাল ১১টার দিকে তারা জানতে পারেন যে, ৩রা নভেম্বর ভোরে ফজরের নামাজের আজানের সময় কারাগারে অনেক গোলাগুলি হয়েছে।

তাদের বাসায় এসে এই খবর জানিয়েছিলেন পুরোনো ঢাকায় তৎকালীন কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশের টিপু সুলতান রোডের একজন বাসিন্দা।

কারাগারে গোলাগুলির খবর জানার পর সিমিন হোসেন রিমি, তাঁর ভাই বোনেরা এবং তাঁদের মা আশে পাশের বিভিন্ন বাসায় গিয়ে সেই বাসার টেলিফোন ব্যবহার করে পরিস্থিতি জানার জন্য বিভিন্ন জায়গায় কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন।

কিন্তু তারা কোনো খবর জানতে পারছিলেন না। এভাবেই দিন গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়।

সিমিন হোসেন রিমি বিকেলে দেখেন সাত মসজিদ রোডে তাদের বাসার সামনে হাজার হাজার মানুষ। তাদের কথা থেকে তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন যে, তাজউদ্দীন আহমদ সহ অনেককে হত্যা করা হয়েছে।

শেষপর্যন্ত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তারা নিশ্চিত হন ৪ঠা নভেম্বর সন্ধ্যার আগে । তখন তাজউদ্দীন আহমদের ছোটবেলার দু’জন বন্ধু তাদের বাসায় আসেন।

এই দু’জনের একজন ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম এটর্নী জেনারেল ফকির সাহাবুদ্দিন। তারাই পরিবারের সদস্যদের কাছে তাজউদ্দীন আহমদসহ চারজন রাজনীতিকের হত্যাকাণ্ডের খবর জানান।

সিমিন হোসেন রিমি জানান, ৪ঠা নভেম্বর রাতে কারা কর্তৃপক্ষ থেকে মৃতদেহ হস্তান্তরের জন্য তাদের সাথে যোগাযোগ করা হয়।

রাত সাড়ে বারটার দিকে পুলিশী পাহারায় মরদেহ তাদের বাসার কাছে আনা হয়। কিন্তু সাত মসজিদ রোডে অনেক মানুষ জড়ো হওয়ায় মৃতদেহ প্রথমে বাসায় নেয়ার ব্যাপারে পুলিশ রাজি হচ্ছিল না। পরে জড়ো হওয়া মানুষদের সরিয়ে দিয়ে তারা মৃতদেহ বাসায় নিয়ে আসে।

সিমিন হোসেন রিমি বলেন, মৃতদেহ বাসায় আনার পর থেকেই দ্রুত দাফনের জন্য তৎপর ছিল পুলিশের লোকজন।

শেষপর্যন্ত ৫ই নভেম্বর ভোর সাড়ে ছয়টার দিকে তাজউদ্দিন আহমদের মৃতদেহ দাফনের জন্য নেয়া হবে জানতে পেরে সাতমসজিদ রোডে কয়েক হাজার মানুষ নিজেরা মৃতদেহ দাফন করার দাবি তোলে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যেখানে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ তিন জন নেতার কবর রয়েছে, সেখানে জেলখানায় নিহত চারজন নেতার জন্য ছাত্রলীগের একদল কর্মী কবর খুঁড়েছিল। সেখানে কবর দেয়ার দাবি করা হচ্ছিল।

কিন্তু পুলিশ সাত মসজিদ রোডে জড়ো হওয়া মানুষকে লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছিল।

পরে ৫ই নভেম্বর বেলা বারটার দিকে পুলিশ মৃতদেহ তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখে সেখানে জানাজা করানোর পর বনানী কবরস্থানে নিয়ে যায়।

সৈয়দ নজরুলের পরিবারও নিশ্চিত হয় পরদিন

মুজিবনগর সরকারে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তাঁকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল শেখ মুজিবকে হত্যার পর ২২শে অগাষ্ট।

তাঁর মেয়ে সৈয়দা জাকিয়া নূর ১৯৭৫ সালে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। এখন তিনি কিশোরগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদসদস্য।

সৈয়দ নজরুল ইসলামের বড় ছেলে আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মৃত্যুর পর ঐ আসনে সংসদ সদস্য হয়েছেন সৈয়দা জাকিয়া নূর।

সৈয়দা জাকিয়া নূর শিশু বয়সে তাঁর বাবার হত্যাকাণ্ডের দিনের ঘটনাপ্রবাহ ততটা না বুঝতে পারলেও পরে অনুভব করেছেন যে, সেই দিনটি ছিল তাদের পরিবারের জন্য বিভীষিকাময়।

৭৫ এর অগাষ্টে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গ্রেফতারের পর তাঁর পরিবারের সদস্যরা পুরোনো ঢাকায় কারাগারের কাছে টিপু সুলতান রোডের বাসায় ছিলেন।

সৈয়দা জাকিয়া নূর জানান, ৩রা নভেম্বর ভোরে তারা কারাগার থেকে পাগলাঘণ্টার শব্দ শুনেছিলেন। সেই শব্দ তাদের আতঙ্কিত করেছিল।

বেলা বাড়ার পর তারা কারাগারের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন পরিস্থিতি জানার জন্য। কিন্তু সেখানে তারা কিছুই জানতে পারেননি।

কারাগারে বন্দি হওয়ার পর থেকে সৈয়দ নজরুল ইসলামের জন্য প্রতিদিন তাঁর বাসা থেকে খাবার পাঠানো হতো। ৩রা নভেম্বরও তারা খাবার পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু দুপুরে খাবার ভর্তি টিফিন ক্যারিয়ার ফেরত আসে।

তখন পরিবারের সদস্যদের উদ্বেগ বেড়ে যায়। পরদিন বিকেল পর্যন্ত তারা নিশ্চিত কোনো খবর পাচ্ছিলেন না।

সৈয়দা জাকিয়া নূর বলেছেন, পরদিন ৪ঠা নভেম্বর বিকেল পাঁচটার দিকে কারগার থেকে দু’জন লোক এসে তাদের জানায় যে, মৃতদেহ শনাক্ত করার জন্য পরিবারের একজন সদস্যকে যেতে হবে। তখন তারা হত্যার বিষয়ে নিশ্চিত হন।

সৈয়দ নজরুল ইসলামের মৃতদেহ পরিবারের সদস্যদের দেখাতে পুরোনো ঢাকার বাড়িতে নেয়া হয়েছিল ৫ই নভেম্বর সকালে।

চারজন রাজনীতিকেরই মৃতদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দাফনের দাবি উঠেছিল।

ফলে পুরোনো ঢাকার আর্মানিটোলা মাঠে জানাজার পর দুপুরে পুলিশী পাহারায় সৈয়দ নজরুল ইসলামের মৃতদেহ নেয়া হয়েছিল বনানী কবরস্থানে।

মনসুর আলীর পরিবার

১৯৭৫ সারের ১৫ই অগাষ্ট শীর্ষ পর্যায়ের যে চারজন রাজনীতিককে গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম এম মনসুর আলী মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রীসভার সদস্য ছিলেন।

তাঁর ছেলে মোহাম্মদ নাসিম শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুর পর ছেলে তানভির শাকিল জয় আওয়ামী লীগ থেকে সিরাজগঞ্জের একটি আসনে সংসদ সদস্য হন।।

দাদী এবং বাবা-চাচার কাছে ৩রা নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে যা জেনেছেন তানভির শাকিল জয়, তাতে তার মনে হয়েছে, হত্যার খবর জানতেই তাদের পরিবারের সে সময় দু’দিন লেগেছিল।

তিনি বলেন, ৭৫ এর ১৫ ই অগাষ্টের হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের ওপর নির্যাতন নেমে এসেছিল। তখন শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের পরিবারের সদস্যদেরও অনেকে আত্নগোপনে থেকেছেন। ফলে ৩রা নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডের খবর জানতেই তাদের অনেক বেগ পেতে হয়েছে।

মনসুর আলীর পরিবারের সদস্যরা ৩রা নভেম্বর সারাদিন হত্যাকাণ্ডের খবর জানতে আত্নীয়স্বজনের মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগের চেষ্টা করেও কিছু জানতে পারছিলেন না।

তারা পরদিন নিশ্চিত খবর জানতে পারেন।

তানভির শাকিল জয় জানিয়েছেন, তাদের একজন আত্নীয় সরকারি চাকরি করতেন। জেলখানা থেকে তাদের সেই আত্নীয়কে মৃতদেহ শনাক্ত করার ব্যাপারে মনসুর আলীর পরিবারকে জানাতে বলা হয়েছিল ৪ঠা নভেম্বর বিকেলে।

সেই আত্নীয়ের মাধ্যমেই তারা হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছিলেন।

এরপর গভীর রাতে মনসুর আলীর মৃতদেহ ধানমন্ডির সোবহানবাগ এলাকায় তাদের বাড়িতে নিয়ে জানাজা করা হয়েছিল।

কামারুজ্জামানের দাফন হয় রাজশাহীতে

এ এইচ এম কামারুজ্জামানও মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রীসভার সদস্য ছিলেন।

তাঁর ছেলে এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন রাজশাহী সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মেয়র হয়েছেন।

১৯৭৫ সালে ৩রা নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডের সময় এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন এবং তাঁর ছোট ভাই ভারতের কোলকাতায় একটি মিশনারী স্কুলে পড়তেন।

তিনি জানিয়েছেন, তিনি তাঁর মায়ের কাছে শুনেছেন যে, হত্যাকাণ্ডের দিনটিতে তাঁর মা নানা গুজব শুনলেও তা বিশ্বাস করেননি।

পরদিন ৪ঠা নভেম্বর বিকেলে তাজউদ্দীন আহমদের স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীন টেলিফোন করে খায়রুজ্জামান লিটনের মায়ের সাথে কথা বলেছিলেন, জেলখানায় কিছু একটা হয়েছে।

তখন তাঁর মা আরও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এরপর ৪ঠা নভেম্বরেও বাসা থেকে মনসুর আলীর জন্য পাঠানো খাবার ফেরত আসে। তখন মি: কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যদের সন্দেহ আরও বেড়ে যায়।

শেখ মুজিবকে হত্যার ঘটনার পর মি: কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যরা মন্ত্রীর বাড়ি ছেড়ে ঢাকার হাতিরপুল এলাকায় ভাড়া বাসায় উঠেছিলেন।

সেই বাসাতেই পরিবারের সদস্যদের মৃতদেহ শনাক্ত করার জন্য খবর দেয়া হয়েছিল ৪ঠা নভেম্বর বিকেলে।

মি: খায়রুজ্জামান জানিয়েছেন, তাঁর বাবার মৃতদেহ রাজশাহীতে দাফন করার ব্যাপারে প্রথমে অনুমতি দেয়া হচ্ছিল না। তবে পরে তাঁর মায়ের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রাজশাহীতে হেলিকপ্টারে করে এ এইচ এম কামারুজ্জামানের মৃতদেহ পাঠানো হয় ৫ই নভেস্বর।

সেদিন রাজশাহীতে তাঁকে দাফন করা হয়।

জাতীয় চার নেতা হত্যাঃ ৪৪ বছর পরও খুনিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে – মহিউদ্দিন ফারুক – প্রথম আলো, ঢাকা – ০৩ নভেম্বর ২০১৯

জেলখানার ভেতর জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল ৪৪ বছর আগে। কিন্তু এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে​ গেছেন খুনিরা। জেলহত্যা মামলা নামে পরিচিত এই মামলার বিচারিক প্রক্রিয়ায় বিচারের তিনটি ধাপ পার হলেও দণ্ডিত ১১ আসামির সবাই পলাতক আছেন, যাঁদের তিনজন মৃত্যুদণ্ড ও আটজন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত। তাঁদের মধ্যে ছয়জন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায়ও দণ্ডপ্রাপ্ত।

আসামিদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিনজন কোথায় আছেন, সে ব্যাপারে সরকারের কাছে নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই। কেবল যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত দুজনের ব্যাপারে তথ্য আছে। তাঁদের মধ্যে কর্নেল (অব.) এম বি নূর চৌধুরী কানাডা এবং লে. কর্নেল (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। তাঁদের ফিরিয়ে আনতে সরকারের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে চেষ্টা চলছে। প্রতিবছর ১৫ আগস্ট এলে এ নিয়ে সরকারের মন্ত্রী-নেতারা অনেক কথা বলেন। পরে এ নিয়ে আর তেমন কোনো আলোচনা থাকে না।

জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা এবং পরে জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলার বিচারকাজ সম্পন্ন হয়েছে। রায় আংশিক কার্যকর হয়েছে। বাকি আসামিরা পলাতক থাকায় তাদের বিরুদ্ধে সাজা কার্যকর করা প্রক্রিয়াধীন। পলাতক যারা বিদেশে আছেন, তাদের ফিরিয়ে আনার সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতা বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে। নির্মম এই ঘটনার ঠিক আগে একই বছরের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যার পর তাঁর ঘনিষ্ঠ এই চার সহকর্মীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল।

জেলখানায় নৃশংস ওই হত্যাযজ্ঞের পরদিন ৪ নভেম্বর তৎকালীন কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন) কাজী আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় সেনাবাহিনীর রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের নাম উল্লেখ করে বলা হয়, তাঁর নেতৃত্বে চার-পাঁচজন সেনাসদস্য কারাগারে ঢুকে চার নেতাকে হত্যা করেন। গুলি করার পরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। ঘটনার পরদিন মামলা করা হলেও এই মামলার তদন্ত থেমে ছিল ২১ বছর। এরপর থেমে থেমে চলে মামলার কার্যক্রম।

দণ্ডিত ১১ আসামির সবাই পলাতক। দুজন ছাড়া বাকি আসামিরা কোথায় আছেন, সে ব্যাপারে সরকারের কাছে নিশ্চিত তথ্যও নেই।

ঘটনার ২৯ বছর পর ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত এই মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে তিন আসামি রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার মো. আবুল হাশেম মৃধাকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

যাবজ্জীবন দণ্ডিত ১২ আসামি হলেন লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর (অব.) বজলুল হুদা ও মেজর (অব.) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, কর্নেল (অব.) খন্দকার আবদুর রশিদ, লে. কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিম, কর্নেল (অব.) এম বি নূর চৌধুরী, লে. কর্নেল (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরী, মেজর (অব.) আহম্মদ শরিফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ, ক্যাপ্টেন (অব.) কিশমত হাশেম, ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমুল হোসেন আনসার।

আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য রায়সহ মামলার নথিপত্র ২০০৮ সালে হাইকোর্টে আসে। এ ছাড়া কারাগারে থাকা যাবজ্জীবন দণ্ডিত চার আসামি সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার) আপিল করেন। ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামির মধ্যে রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। মারফত আলী শাহ ও দফাদার আবুল হাশেম মৃধা মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস পান। আপিলকারী চার দণ্ডিত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে খালাস পান। যাবজ্জীবন দণ্ডিত অপর আট আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল থাকে।

অবশ্য সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ (‍ল্যান্সার) জেল হত্যায় অব্যাহতি পেলেও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি তাঁদের ফাঁসি কার্যকর হয়।

এদিকে জেলহত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে পরে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। আপিল বিভাগ দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার মো. আবুল হাশেম মৃধাকে হাইকোর্টের খালাসের রায় বাতিল করে বিচারিক আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। ২০১৫ সালের ১ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। কিন্তু ১১ আসামির কাউকে আজ পর্যন্ত সাজার আওতায় আনা যায়নি। আসামিদের সবার অবস্থান সম্পর্কেও নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি।

জেলহত্যায় নিহত চার নেতার একজন এ এইচ এম কামারুজ্জামানের ছেলে রাজশাহীর মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘চার নেতার পরিবারের অন্য সদস্যদের মতো আমারও দাবি, আসামিদের দেশের বাইরে থেকে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করা হোক৷’

জেলহত্যা মামলাঃ সাজাপ্রাপ্ত ১০ আসামি পলাতক – মহিউদ্দিন ফারুক, প্রথম আলো, ঢাকা, ০২ নভেম্বর ২০২২

জাতীয় চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যার ৪৭ বছর। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় পলাতক দুই আসামিকে ফিরিয়ে আনা যায়নি।

জাতীয় চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় সাজাপ্রাপ্ত ১১ আসামির মধ্যে ১০ জনই এখনো পলাতক। এ মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামি কোথায় আছেন, সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত দুজন বিদেশে রয়েছেন। তাঁদের এখনো ফিরিয়ে আনা যায়নি।

রাতের আঁধারে কারাগারে বন্দী অবস্থায় ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতা মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলাটি জেলহত্যা মামলা নামে পরিচিত। এ ঘটনার আড়াই মাস আগে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে সপরিবার হত্যা করা হয়।

জাতীয় চার নেতাকে হত্যার ঘটনায় ১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর তৎকালীন কারা উপমহাপরিদর্শক কাজী আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় বলা হয়, রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের নেতৃত্বে চার-পাঁচজন সেনাসদস্য কারাগারে ঢুকে চার নেতাকে গুলি করেন এবং বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাঁদের মৃত্যু নিশ্চিত করেন।

এ মামলার তদন্ত থেমে ছিল ২১ বছর। ১৯৯৬ সালের জুন মাসে আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মামলার কার্যক্রম শুরু হয়। ২৯ বছর পর ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে তিন আসামি রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার মো. আবুল হাশেম মৃধাকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ১২ আসামি হলেন লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর (অব.) বজলুল হুদা, মেজর (অব.) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, কর্নেল (অব.) খন্দকার আবদুর রশিদ, লে. কর্নেল (অব.) শরীফুল হক ডালিম, কর্নেল (অব.) এম বি নূর চৌধুরী, লে. কর্নেল (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরী, মেজর (অব.) আহম্মদ শরিফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ, ক্যাপ্টেন (অব.) কিশমত হাশেম এবং ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমুল হোসেন আনসার।

পরে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত চার আসামি সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা এবং এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার) বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন। ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে তাঁরা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে খালাস পান। অপর আট আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল থাকে। দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার মো. আবুল হাশেম মৃধাকে হাইকোর্টের রায়ে খালাস দেওয়া হয়েছিল। তবে আপিল বিভাগ বিচারিক আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন।

অবশ্য জেলহত্যা মামলায় অব্যাহতি পেলেও ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা এবং এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদের (ল্যান্সার) ফাঁসি কার্যকর হয়। সর্বশেষ ২০২০ সালের ১১ এপ্রিল দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর হয়, যিনি জেলহত্যা মামলায়ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত।

জেলহত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কর্নেল (অব.) এম বি নূর চৌধুরী কানাডা এবং লে. কর্নেল (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরী আছেন যুক্তরাষ্ট্রে। তাঁদের ফিরিয়ে আনতে সরকারের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে চেষ্টা চলছে।

বাসস জানাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে এক অনুষ্ঠানে বলেন, খুনি রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনুরোধ করা হয়েছে।

এদিকে কানাডার হাইকমিশনার লিলি নিকোলস গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতে নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠানোর জন্য বিকল্প পথ খুঁজতে কানাডার প্রতি অনুরোধ জানান আইনমন্ত্রী।

বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামি নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কানাডার আইনে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে ফেরত দেওয়া সম্ভব নয় বলে হাইকমিশনার জানিয়েছেন। তাঁদের অনুরোধ করেছি, বিকল্প পন্থা বের করা যায় কি না। তাঁকে বলেছি, একজন খুনিকে আশ্রয় দেওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘন। হাইকমিশনার বলেছেন, কানাডা সরকারকে বিষয়টি তিনি জানাবেন।’

জাতীয় চার নেতার একজন এ এইচ এম কামারুজ্জামানের ছেলে রাজশাহীর মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান। গত মঙ্গলবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘চার নেতার পরিবারের অন্য সদস্যদের মতো আমারও দাবি, আসামিদের দেশের বাইরে থেকে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করা হোক।

আশায় আশায় দিন পার করছি।’ তিনি বলেন, ‘দণ্ড কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সরকার চেষ্টা করছে তাদের ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকরের জন্য। সরকার সফল হবে বলে আশা করছি।’

জাতীয় ৪ নেতা হত্যা: ১৭ বছরেও পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনা যায়নি – মতিউর রহমান চৌধুরী – ভয়েস অব আমেরিকা –

প্রায় ৪৬ বছর আগে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের চার গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে। এই জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় হয়েছে ১৭ বছরেরও বেশি সময় আগে। ‘জেলহত্যা মামলা’ খ্যাত এই মামলার ১১ জন আসামির মধ্যে ১০ জনই পলাতক। এ মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় তার ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছে। বাকি আসামির মধ্যে দুইজনের অবস্থানের বিষয়ে সরকারের কাছে তথ্য রয়েছে। অন্য আসামিরা কোথায় আছেন তার কোনো তথ্য নেই।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের মধ্য দিয়ে রায় আংশিক কার্যকর হয়েছে৷ আর যারা পলাতক আসামি রয়েছেন তাদের আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি৷ যখন আসামিদের নিজেদের আওতায় পাবো তখনই ফাঁসির রায় কার্যকর হবে৷

নাজিম উদ্দিন রোডে অবস্থিত পুরাতন কারাগারে জেল হত্যা দিবস উপলক্ষে জাতীয় চার নেতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের একথা জানান৷ তবে রায় কার্যকর করার জন্য দৃশ্যত কোন উদ্যোগ নেওয়া করা হয়নি৷

এমন বাস্তবতায় আগামীকাল ৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবস পালিত হবে৷

১৯৭৫ সালের এই দিনে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীর সেনানী ও চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, এএইচএম কামারুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে এই দিনে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়৷

তারা ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবন রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ও মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতা৷ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর খুনিচক্র কারান্তরালে চার নেতাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে৷ বাংলাদেশের ইতিহাসে এটা একটি কালো অধ্যায়৷

মামলার বিচার

হত্যাকাণ্ডের পরদিন তৎকালীন ডিআইজি (প্রিজনস) কাজী আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় মামলা করেন৷ কিন্তু ২১ বছর এ হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হয়৷ ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে জেলহত্যা মামলা পুনরুজ্জীবিত করে৷

তদন্ত শেষে সিআইডি ১৯৯৮ সালের ২০ অক্টোবর ২০ জনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দেন৷ এরপর ৬ বছরের বেশি সময় চলে বিচারকাজ৷ জেলহত্যার ২৯ বছর পর ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত মামলার রায় ঘোষণা করেন৷

যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে হাইকোর্ট ২০০৮ সালে সৈয়দ ফারুক রহমান, শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা ও এ কেএম মহিউদ্দিনকে খালাস দেন৷ তবে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামি হিসাবে এ চারজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷

এদিকে বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হলে হাইকোর্ট ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট এক রায়ে শুধু রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন৷ আর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার আবুল হাসেম মৃধা এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অপর চার আসামিকে খালাস দেওয়া হয়৷

হাইকোর্টে খালাসপ্রাপ্ত এ চারজনের ফাঁসি কার্যকর হয় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায়৷

অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকার ফের ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হয়৷ ফাঁসির তিন আসামির মধ্যে শুধু দুজনকে খালাস দেওয়ায় রায়ের ওই অংশটির বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ৷

নতুন এক আসামী আটক

এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে জেল হত্যা মামলার আসামি সাবেক হাইকমিশনার খায়রুজ্জামানকে মালয়েশিয়ায় আটক করা হয়৷

সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা ২০০৪ সালে জেল হত্যা মামলা থেকে খালাস পান৷ ২০০৫ সালে তিনি মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাসে নিয়োগ পান৷ পরে ২০০৭ সালের আগস্টে তাকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়৷

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর খায়রুজ্জামানকে দেশে ফিরে আসার নির্দেশ দেওয়া হয়৷ তিনি সেই নির্দেশ অমান্য করে মালয়েশিয়ায় থেকে যান৷

পরে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) দেওয়া শরণার্থী মর্যাদায় খায়রুজ্জামান মালয়েশিয়ায় অবস্থান করেন৷ জানা গেছে, খায়রুজ্জামান এখন শরণার্থী হিসেবে ইউএনএইচসিআরের যে কার্ডটি ব্যবহার করেন, সেটি ২০২০ সালের মার্চে তাকে দেওয়া হয়৷ তাকে দেওয়া কার্ডটির মেয়াদ ২০২৪ সাল পর্যন্ত৷

তাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখমুখি করা হবে বলে সে সময় সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম৷

কর্মসূচি

জাতীয় চার নেতা হত্যার দিনটি জেলহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে৷ যেখানে চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল, ঢাকার সেই পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারে গড়ে তোলা হয়েছে জাদুঘর৷

প্রতি বারের মতো এবারও যথাযথ মর্যাদায় শোকাবহ এই দিবসটি স্মরণ করবে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠন৷

আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, আগামীকাল সূর্য উদয়ের সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু ভবন ও দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ দেশের সর্বত্র দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ, কালো পতাকা উত্তোলন৷

সকাল ৭টায় ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ৷ সকাল  ৭টা ৩০ মিনিটে  বনানী কবরস্থানে জাতীয় চার নেতার কবরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, ফাতেহা পাঠ, মিলাদ মাহফিল ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে৷ একই ভাবে রাজশাহীতে জাতীয় নেতা কামারুজ্জামানের কবরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, ফাতেহা পাঠ, মিলাদ মাহফিল ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে৷ এছাড়াও জেল হত্যা দিবস উপলক্ষে বিকাল তিনটায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আলোচনাসভা হবে৷

মন্তব্যসমূহ
বই পড়তে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি' এ্যাপটি ব্যবহার করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button