বই-দলিলপত্র-প্রবন্ধ
Trending

জেল হত্যা মামলা ও বিচার – মাহমুদ জাহাঙ্গীর আলম

বই পড়তে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি' এ্যাপটি ব্যবহার করুন।

জেল হত্যা মামলা ও বিচার

মাহমুদ জাহাঙ্গীর আলম

২০২০

জেলখানার অভ্যন্তরে জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডটি অত্যন্ত নির্মম ও জঘন্যতম। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এএইচএম কামরুজ্জমান ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর ভূমিকা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।

শুধু স্বাধীনতা সংগ্রামেই নয়, এ দেশের নিপীড়িত-নির্যাতিত জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহযোগী হিসেবে তারা ছিলেন সামনের কাতারে। অথচ ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, এ দেশের মাটিতে জেলখানার অভ্যন্তরে তাদের জীবন দিতে হয়েছে কয়েকজন বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে। জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করেই ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে থাকেননি।

ইতিহাসের এ জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথও রুদ্ধ করে দেয়া হয় কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে। অবশেষে এ হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করার পর তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই সিআইডির এএসপি আবদুল কাহ্হার আকন্দ দীর্ঘ তদন্ত করে ২১ জন আসামির বিরুদ্ধে ১৫-১০-৯৮ তারিখে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ১৯৯৬-২০০১-এর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হয়। তৎকালীন সরকার এ বিচারের ক্ষেত্রে কোনো হস্তক্ষেপ বা প্রভাবান্বিত করার চেষ্টা করেনি।

মামলার ঘটনা ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর। তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত কাজ শুরু করেন ঘটনার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে। এত দীর্ঘ সময় পর মামলার আলামত ও সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আর দীর্ঘ সময় পর সাক্ষ্য প্রদানের সময় সাক্ষীদের সবকিছু স্মরণ থাকাটাও অনেক ক্ষেত্রে অসুবিধাজনক। বিচারকদের অবশ্যই এসব বিবেচনায় আনতে হয়। উচ্চতর আদালতের নজিরেও এ সম্পর্কে দিকনির্দেশনা রয়েছে। রায়ে মামলার এজাহার সম্পর্কে অনেক মন্তব্য করা হয়েছে।

তাতে উল্লেখ করা হয়, ‘অত্র মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তা দীর্ঘ ২১ বৎসর পর মামলাটির তদন্তভার প্রাপ্ত হইয়া তল্লাশি করিয়া মূল এজাহারখানা প্রাপ্ত না হইলেও উহার একটি ফটোকপি প্রদর্শনী হিসেবে আদালতের সামনে আনয়ন করিতে সমর্থ হয়। বাদীর বক্তব্য হইতে ইহা প্রতীয়মান হয় যে, তিনি প্রদঃ ১-এর ন্যায় একটি এজাহার ৪-১১-৭৫ তারিখে বাদীপক্ষের ৩৭নং সাক্ষী এবিএম ফজলুল করিম, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, লালবাগ থানা-এর বরাবরে প্রেরণ করিয়াছিলেন।

ইহা স্বীকৃত যে তাহার কাছে রক্ষিত এজাহারের কপি, থানায় রক্ষিত এজাহারের কপি এবং জুডিশিয়াল রেকর্ডে রক্ষিত এজাহারের বিষয়বস্তু এক। প্রদঃ ১ ও ৩ এ যাহা কিছু লেখা আছে উহা যাহা বাদীর লেখা ও স্বাক্ষরিত না হইলেও তাহার বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, প্রদঃ ১ এর ন্যায় তিনি একটি এজাহার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লালবাগ থানা বরাবরে ৪-১১-৭৫ তারিখে প্রেরণ করিয়াছিলেন। ৩নং সাক্ষীর সাক্ষ্য ইহা প্রমাণ করে যে, ৪-১১-৭৫ইং বাদী এবং তিনি আলাপ আলোচনাক্রমে জেল হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে একখানা এজাহারের মাধ্যমে অত্র মোকদ্দমাটি দায়ের করেন এবং উহা বাদীপক্ষ ১৯৭৫ সনের খতিয়ান বহিসহ সম্পত্তি বহি দ্বারা প্রমাণ করিতে সক্ষম হইয়াছে।

ইহা প্রমাণিত হয় যে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৪ জাতীয় নেতার হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে যে মামলাটি দায়ের হয় উহা অত্র মামলা। বাদীপক্ষের ১ নং সাক্ষী কাজী আব্দুল আউয়াল ঘটনাটির সবিস্তারিত বর্ণনা দিয়া ৫-১১-৭৫ইং তারিখে আইজি প্রিজনের নিকট অফিসিয়ালি একটি মেমো নং ৫৫৭২/ডি আই জি/৭৫ তাং ৫-১১-৭৫ মূলে প্রেরণ করেন। অত্র মোকদ্দমার তদন্তকারী অফিসার আবদুল কাহ্হার আকন্দ উক্ত রিপোর্টের টাইপ কপির একটি ফটোকপি জব্দক্রমে আদালতে প্রদর্শনী-২ রূপে উপস্থাপনা করেন। বাদীপক্ষের ১ নং সাক্ষী কাজী আব্দুল আউয়াল তাহার সাক্ষ্যে তাহার কর্তৃক উক্ত রিপোর্টের কথা স্বীকার করেন।’

রায় থেকে দেখা যায়, তদন্তকারী কর্মকর্তা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বাদীর সই করা এজাহারের কপি, আইজি অফিস থেকে সংগৃহীত এজাহারের কপি এবং মামলার সিডিতে থাকা কপি আদালতে দাখিল করেন এবং এগুলো প্রদর্শনী-১, ২ ও ৩ হিসেবে চিহ্নিত হয়। বাদীপক্ষের ১নং সাক্ষী বাদী কাজী আবদুল আউয়াল এবং ৩নং সাক্ষী তৎকালীন আইজি প্রিজন এজাহার ও এজাহারের বিষয়বস্তু স্বীকার করেন। জেলখানায় খতিয়ান বই ও সম্পত্তি বই দ্বারা তা সমর্থিত হয়। বিজ্ঞ বিচারক তার রায়ে উল্লেখ করেন, ‘বাদীপক্ষের ১ ও ৩ নং সাক্ষীর সাক্ষ্যমতে প্রমাণিত হয় যে, প্রদর্শনী ১-এর অনুরূপ একখানা এজাহার অত্র মামলার ঘটনার ওপর দায়ের করা হইয়াছিল। এজাহারখানা দায়ের সঠিক ও তাহা ভিত্তিহীন নয়।’

২১ বছর আগে লালবাগ থানায় করা মামলার মূল এজাহার না পাওয়ায় মামলাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে গণ্য করা যায় না। আর তা তদন্তকারী কর্মকর্তার গাফিলতি হিসেবেও চিহ্নিত করা যায় না। কেননা তিনি তার সাক্ষ্যে উল্লেখ করেন, মূল এজাহার সংগ্রহ করার চেষ্টা করেও তিনি তা পাননি। যেখানে মামলার কার্যক্রমই বন্ধ করে দেয়া হয়, সেখানে এজাহারের মূল কপিটি গায়েব করে দেয়া কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। বিজ্ঞ মহানগর দায়রা জজ রায়ে উল্লেখ করেন, ‘প্রদঃ ১ হইতে ইহা পরিলক্ষিত হয় নাই যে, জেল হত্যাকাণ্ডের তথাকথিত যড়যন্ত্রের কিংবা যোগসাজশের কথা ইহাতে বলা হয়। শুধু ক্যাপ্টেন মোসলেম এবং তাহার সঙ্গীয় সশস্ত্র আর্মি দ্বারা হত্যাকাণ্ড সংঘটনের কথা বলা হইয়াছে।’

রায়ে উল্লেখ করা হয়, ‘তদন্তকারী কর্মকর্তা আব্দুল কাহ্হার আকন্দ অর্থাৎ বাদীপক্ষের ৬৪ নং সাক্ষী অত্র মামলাটি তদন্তকার্য পরিচলানা করিতে গিয়া এমন কোনো সাক্ষ্য আদালতের সামনে উপস্থাপন করিতে পারেন নাই- যাহা দ্বারা জেলখানা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ৯ জন হত্যাকারীর নাম আদালতের সামনে প্রকাশ পায় ও প্রমাণিত হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রকৃতপক্ষে হত্যাকারীদের এবং হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ক্যাপ্টেন মোসলেম ছাড়া অপর ৮ জন আসামির ব্যাপারে কোনোরূপ তদন্তকার্য পরিচালনা করেন নাই। আর্মির নায়েক এ আলী ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকিলেও এবং নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটাইলেও অত্র মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আব্দুল কাহ্হার আকন্দ তাহাকে রহস্যজনকভাবে অজ্ঞাত কারণে আসামিভুক্ত করেন নাই।’

বাদীপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্য পর্যালোচনা করেও দেখা যায়, ওই তিন আসামি ব্যতীত জেলখানা হত্যা সংঘটনকারী অন্যদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। জেলখানার সাক্ষীরা অর্থাৎ ১ থেকে ১০ নং সাক্ষী কেবল রিসালদার পরবর্তী সময়ে ক্যাপ্টেন মোসলেম উদ্দীন ব্যতীত অন্য কোনো সেনাসদস্যের নাম বলতে পারেননি। বঙ্গভবনের খেদমতগার বাদীপক্ষের ১৩ নং সাক্ষী মো. সাখাওয়াত হোসেন ও ১৮ নং সাক্ষী মানিক মিয়া তাদের সাক্ষ্যে ক্যাপ্টেন মোসলেম উদ্দীন, দফাদার মারফত আলী ও দফাদার আবুল হাসেম মৃধা বঙ্গভবন থেকে বের হয়ে জেলখানায় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে আবার ফিরে আসার বিষয় উল্লেখ করেন।

তারা তাদের সাক্ষ্যে ওই তিনজন আসামির সঙ্গে আরও ২-৩ জন নিু র‌্যাংকের আর্মি ছিল বলে উল্লেখ করেন, যাদের নাম বলতে পারেননি। বাদীপক্ষের ২১ নং সাক্ষী রাষ্ট্রপতির এডিসি গোলাম রাব্বানী তার সাক্ষ্যে জেল হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার ব্যাপারে ক্যাপ্টেন মোসলেম এবং তার সঙ্গীয় ৪ জন সশস্ত্র সেনাসদস্যের মধ্যে দফাদার মারফত আলী ও দফাদার হাসেম মৃধাকে শনাক্ত করেন। ১৭নং সাক্ষী বঙ্গভবনে কর্মরত সহকারী কাম পিএ খান মোহাম্মদ অলক তার সাক্ষ্যে বলেন, ক্যাপ্টেন মোসলেম, দফাদার মারফত আলী শাহ এবং দফাদার আবুল হাসেম মৃধাকে জেলখানায় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর ভোরে বঙ্গভবনে অত্যন্ত ক্লান্ত অবস্থায় ফিরে আসতে দেখেন।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, বাদীপক্ষের কোনো সাক্ষীই জেলখানায় প্রবেশকারী খুনি ৫ সশস্ত্র সেনাসদস্যের মধ্যে ক্যাপ্টেন মোসলেম উদ্দীন, দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার আবুল হাসেম মৃধা ব্যতীত বাকি দু’জনকে শনাক্ত করতে পারেননি এবং তাদের পরিচয় সম্পর্কে বলেননি। তদন্তকারী কর্মকর্তা যে তিনজন আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ পেয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছেন এবং সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। নায়েক এ আলীসহ বাকি দু’জনকে শনাক্ত করতে না পারায় এবং সাক্ষ্য-প্রমাণ না পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া সম্ভব হয়নি। নায়েক এ আলী নামে ভুয়া স্বাক্ষর করাটাও অস্বাভাবিক নয়।

রায়ে উল্লেখ করা হয়, ‘বাদীপক্ষের দাবি অনুযায়ী তথাকথিত যড়যন্ত্র, যোগসাজশ, প্ররোচনা ও সহায়তার বিষয়ে বঙ্গভবনে প্রকাশ ঘটলে সেই বিষয়ে এ সাক্ষীর তদন্ত করা উচিত ছিল এবং ঐ মর্মে এই সাক্ষী কোনো তদন্ত করেন নাই বলিয়া দেখা যায়।’

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কর্মরত তৎকালীন কর্মকর্তাদের সম্পর্কে রায়ে উল্লেখ করা হয়, ‘জেলখানার ১ হইতে ৩ নং সাক্ষী এবং জেলখানার কর্মরত সদস্যদের সামনে ইতিহাসের জঘন্যতম অপরাধ জেল হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হইলেও তাহারা উহার পূর্বে কিংবা ঘটনার সময় কোনোরূপ প্রতিরোধ বা প্রতিবাদ না করিয়া বরং জেলখানায় পাগলা ঘণ্টি বাজাইয়া জাতীয় চার নেতাকে রক্ষার পরিবর্তে খুনিদের দ্বারা নিহতদের পৈশাচিক এবং নৃশংসভাবে হত্যা করিতে সাহায্য ও সহায়তা করেন। এই সমস্ত সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অত্র মামলার আসামিদের সঙ্গে তদন্তক্রমে বিচারার্থে আদালতের সামনে সোপর্দ না করিয়া রহস্যজনকভাবে জেল হত্যাকাণ্ডের দায় হইতে দূরে রাখিয়াছেন।

তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদের নির্দেশ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের পৃষ্ঠা নং ১০৭ মোতাবেক তাহার উপর বাধ্যকর ছিল না কিংবা ১ হইতে ৩ নং সাক্ষীর উপর বাধ্যকর ছিল না। ১ হইতে ৩ নং সাক্ষী উপরোক্ত আইন ভঙ্গ করিয়া উপরোল্লিখিত ক্যাপ্টেন মোসলেম এবং তাহার সঙ্গীয় ৪ সশস্ত্র সেনাসদস্যকে রাষ্ট্রপতির বেআইনি অলিখিত আদেশ ও নির্দেশে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঘটনার তারিখ ও সময়ে খুনিদের প্রবেশ করিতে দিয়া জাতীয় চার নেতাকে নৃশংস ও পৈশাচিকভাবে হত্যা করিতে সাহায্য, সহায়তা ও সহযোগিতা করিয়া অপরাধ করিয়াছেন।’

মহানগর দায়রা জজ কর্তৃক প্রদত্ত রায়ে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণ করার জন্য দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারায় আসামি রিসালদার মোসলেম উদ্দীন, দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার আবুল হাসেম মৃধাকে মৃত্যুদণ্ড এবং তাদের প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা জরিমানা, দণ্ডবিধির ৩০২/১০৯ ধারায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব্যাহতি) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর (অব.) বজলুল হুদা, লে. কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আবদুর রশিদ, লে. কর্নেল (অব্যাহতি) শরীফুল হক ডালিম, লে. কর্নেল (অব.)।

এমএইচএমবি নূর চৌধুরী, লে. কর্নেল (অব.) একেএম মহিউদ্দীন আহমেদ, লে. কর্নেল (অব.) এএম রাশেদ চৌধুরী, মেজর (অব.) আহমদ শরফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ, ক্যাপ্টেন (অব্যাহতি) মো. কিসমত হাসেম ও ক্যাপ্টেন (অব্যাহতি) নাজমুল হোসেন আনসারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং তাদের প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ৬ মাসের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। তাহের উদ্দীন ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, কেএম ওবায়দুর রহমান ও নূরুল ইসলাম মঞ্জুরের বিরুদ্ধে এ নির্মম হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন মর্মে কোনো প্রমাণ না পাওয়ায় তাদের খালাস প্রদান করা হয়। লে. কর্নেল (অব্যাহতি) আবদুল আজিজ পাশা মৃত্যুবরণ করায় তাকে কোনো সাজা প্রদান করা হয়নি।

মহানগর দায়রা জজ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে আসামি সৈয়দ ফারুক রহমান ৪৭৩৯/২০০৪ ফৌজদারি আপিল, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ৪৭৪০/২০০৪নং ফৌজদারি আপিল এবং বজলুল হুদা জেল আপিল নং ১১৮/২০০৬ এবং একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ জেল আপিল নং ৫৯৭/২০০৭ দায়ের করেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিনজন আসামি মোসলেম উদ্দিন, মারফত আলী শাহ ও আবুল হাসেম মৃধার ১৫০/২০০৪নং ডেথ রেফারেন্স কনফারমেশনের জন্য হাইকোর্ট বিভাগে আসে।

হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খান ডেথ রেফারেন্স এবং ৪টি আপিল একত্রে শুনানি করে ২৮-০৮-২০০৮ তারিখে রায় প্রদান করেন। হাইকোর্ট বিভাগের ২৮-০৮-২০০৮ তারিখের রায়ে ডেথ রেফারেন্স আংশিক মঞ্জুরক্রমে রিসালদার মোসলেম উদ্দীনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রাখা হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর দুই আসামি দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার আবুল হাসেম মৃধাকে খালাস প্রদান করা হয়। আপিল চারটি মঞ্জুরক্রমে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশপ্রাপ্ত আসামি সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা ও একেএম মহিউদ্দিন আহমেদকে খালাস প্রদান করা হয়।

রাষ্ট্রপক্ষে হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক আসামি মারফত আলী শাহ ও আবুল হাসেম মৃধার মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস এবং যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা ও একেএম মহিউদ্দিন আহমেদের খালাসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে ২৩/২০১১নং ফৌজদারি আপিল মামলা করা হয়। কিন্তু ওই চারজন আপিলকারী আসামির বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ২৮-০১-২০১০ তারিখে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে আনীত লিভ আবেদন খারিজ করা হয়।

আসামি খন্দকার আবদুর রশিদ, শরীফুল হক ডালিম, এমএইচএমবি নূর চৌধুরী, এএম রাশেদ চৌধুরী, আহমদ শরফুল হোসেন, মো. কিসমত হাসেম ও নাজমুল হোসেন আনসারের পক্ষে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে কোনো আপিল করা হয়নি। তাই তাদের বিরুদ্ধে মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রদত্ত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ বহাল আছে। ওই আসামিদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এমএইচএমবি নূর চৌধুরী ও এএম রাশেদ চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। ওই আসামিরা পলাতক আছেন। জেলহত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। ২০২০ সালের ১১ এপ্রিল তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে।

মহানগর দায়রা জজ আদালত কর্তৃক অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের দণ্ডবিধির ১২০বি ধারার অভিযোগ থেকে খালাসের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ বা নিহতের পরিবার কোনো আপিল হাইকোর্ট বিভাগে দায়ের করেননি। সাক্ষ্য-প্রমাণে আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের দণ্ডবিধির ১২০বি ধারার অপরাধের প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ইতোপূর্বে এ সম্পর্কে কোনো আপলি দায়ের না করায় আপিল বিভাগ এ ধারায় তাদের কোনো সাজা দিতে পারেননি।

বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ কর্তৃক ৩০-০৪-২০১৩ তারিখে রায় ঘোষণা করা হয়। এ রায়ে হাইকোর্ট বিভাগের রায় বাতিল করে মহানগর দায়রা জজ কর্তৃক প্রদত্ত দণ্ডাদেশ বহাল রাখা হয়। ওইদিন শুধু আদেশের অংশটি বলা হয়। পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রদান করা হয় এর প্রায় তিন বছর পরে ০১-১২-২০১৫ তারিখে। চূড়ান্ত রায়ে রিসালদার মোসলেম উদ্দীন, দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার আবুল হাসেম মৃধার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। তারা তিনজনই পলাতক রয়েছেন।

জেলহত্যার বিচার / যুগান্তর / ০৫ নভেম্বর ২০২০ / মাহমুদ জাহাঙ্গীর আলম : সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ (অবসরপ্রাপ্ত)

মন্তব্যসমূহ
বই পড়তে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি' এ্যাপটি ব্যবহার করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button