বই-দলিলপত্র-প্রবন্ধ
Trending

মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচার আন্দোলন একাত্তরের ঘাতক দালাল র্নিমূল কমিটির ভূমিকা – তপন পালিত

বই পড়তে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি' এ্যাপটি ব্যবহার করুন।

মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচার আন্দোলন একাত্তরের ঘাতক দালাল র্নিমূল কমিটির ভূমিকা

তপন পালিত

২০১৭

১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে দলনিরপেক্ষ ১০১ জন বিশিষ্ট নাগরিকের উদ্যোগে গঠিত হয়েছিল একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। এর এক মাসেরও কম সময়ে নির্মূল কমিটিসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ৭২টি রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’। এই সমন্বয় কমিটির উদ্যোগে৯৯২ সালের ২৬ মার্চ গণআদালতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়। নির্মূল কমিটি গঠনের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ৭ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার লে. কর্নেল (অবঃ) কাজী নূর-উজ্জামান, লেখক-সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির ও শহীদজননী জাহানারা ইমাম। জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠনের পর শহীদজননী পুরো সময় সমন্বয়ের কার্যক্রমে নিজেকে যুক্ত করেন। শাহরিয়ার কবির আংশিক নির্মূল কমিটি এবং আংশিক সমন্বয়ের কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন। ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন শহীদজননী জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর জাতীয় সমন্বয় কমিটির নেতৃত্বে শূন্যতার সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া সমন্বয়ের শরিক রাজনৈতিক দলগুলো এই আন্দোলন থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়। ফলে সমন্বয় কমিটির কর্মকাণ্ড একরকম বন্ধই হয়ে যায়।

শহীদজননী জাহানারা ইমাম সূচিত ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধের এই আন্দোলনের গুরুত্বের কথা বিবেচনায় রেখে রাজপথে এই আন্দোলন অব্যাহত রাখার জন্য ‘৯৫ সালে নির্মূল কমিটি পুনর্গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। শহীদজননীর আন্দোলনের বহুমাত্রিক বিস্তার এবং এই আন্দোলন তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে এই আন্দোলনের কর্মীবাহিনীকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলীয়ান করার লক্ষ্যে ওয়ার্ড ও থানা পর্যায়ে তরুণ কর্মীদের জন্য কর্মশালা করা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন প্রজন্মকে সচেতন করা এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার লক্ষ্যে ‘মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতি পাঠাগার’ স্থাপন এবং মুক্তিযুদ্ধ মেলার আয়োজন করা। এ ছাড়া প্রতি বছর শহীদজননী জাহানারা ইমাম স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করা, শহীদজননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদক প্রদানের ব্যবস্থা করা, জেলা পর্যায়ে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়মিত মতবিনিময় করা এবং বিভিন্ন প্রকাশনাসহ ঘোষিত সকল কর্মসূচি পালন করা হয়। এ সকল নিয়মিত কর্মসূচি ছাড়াও নির্মূল কমিটি প্রতিনিয়তই দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধা, দুঃস্থ শহীদ পরিবার এবং বীরাঙ্গনা, সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের শিকার পরিবারসমূহকে চিকিৎসা, আইনি ও আর্থিক সহযোগিতা প্রদানসহ তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতি অনুযায়ী বিভিন্ন সময়ে বন্যার্ত ও শীতার্ত মানুষের পাশেও দাঁড়িয়েছে।

১৯৯৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের অপকর্ম অনুসন্ধানের জন্য গঠন করা হয়েছিল জাতীয় গণতদন্ত কমিশন। এই গণতদন্ত কমিশনের চেয়ারপারসন ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। তার নেতৃত্বে মূলত নির্মূল কমিটির তরুণ নেতা-কর্মীবৃন্দ এবং শুভানুধ্যায়ীরা মাঠ পর্যায়ে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এই তদন্ত কাজ সম্পন্ন করেন। ১৯৯৩ এবং ১৯৯৪ সালে ২ খণ্ডে ১৬ জন যুদ্ধাপরাধীর দুষ্কর্মের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এরপরও নির্মূল কমিটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও নিপীড়নের ঘটনার অনুসন্ধান এবং ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দী নথিকরণের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। এই সব জবানবন্দির ভিত্তিতে ১৯৯৯ সালে ‘একাত্তরের দুঃসহ স্মৃতি’ সহ বেশ কয়েকটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ গঠনের পর ‘৭১-এর গণহত্যাকারীদের দুষ্কর্মের তদন্ত প্রতিবেদন এবং ভুক্তভোগীদের জবানবন্দি প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থাকে নির্মূল কমিটি প্রদান করে।

২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহের ওপর যে নজিরবিহীন নির্যাতন চলেছে তার উপর প্রায় তিন হাজার পৃষ্ঠার শ্বেতপত্র ২০০৫ সালে প্রকাশ করেছে। এরপর ২০১৪ এবং ২০১৬ সালে অনুরূপ আরও দুটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়েছে, যার পৃষ্ঠাসংখ্যা চার হাজারের উপরে। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং জঙ্গী মৌলবাদীদের কার্যক্রম সম্পর্কে নিয়মিত শ্বেতপত্র প্রকাশের সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে এবং এ লক্ষ্যে তথ্য সংগ্রহের কাজ অব্যাহত রয়েছে।

২০১০ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত নির্মূল কমিটির জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার বিঘ্নিত ও বানচালের উদ্দেশ্যে দেশে-বিদেশে জামায়াত ও সমমনা বিভিন্ন দলের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করা। আরও চ্যালেঞ্জিং ছিল সর্বোচ্চ আদালতে শীর্ষস্থানীয় গণহত্যাকারীদের বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা এবং ট্রাইব্যুনালের রায় পরিবর্তনের সম্ভাবনা। এই ষড়যন্ত্র মোকাবেলার কর্মসূচিতে নির্মূল কমিটির সঙ্গে শরিক হয়ে দুই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীকে আদালত অবমাননার জন্য শাস্তিও পেতে হয়েছে, কিন্তু নির্মূল কমিটি তাদের অবস্থানে অনড় থেকে নিজামী, সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরী, মুজাহিদ ও মীর কাশেমের মতো শীর্ষস্থানীয় মানবতাবিরোধীদের মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করতে পেরেছে। নির্মূল কমিটির আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সৃষ্টি হওয়া শাহবাগের তারুণ্যের মহাজাগরণ যেমন জাতি প্রত্যক্ষ করেছে, সরকার উৎখাতের জন্য হেফাজত-জামায়াত-বিএনপির মহাতাণ্ডব ও আগুনসন্ত্রাসও তেমনি বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে। ২০১৩ সালে ঢাকার বাইরে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত জেলা উপজেলা পর্যায়ে অধিকাংশ গণজাগরণ মঞ্চ স্থানীয় নির্মূল কমিটির প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় গঠিত হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০১৩ সালের মে মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হেফাজতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে তাদের দমন করা সম্ভব হয়েছিল।

নির্মূল কমিটিকে ক্রমাগত লড়তে হয়েছে হেফাজত-জামায়াত-বিএনপির মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। সংখ্যালঘু ধর্মীয় ও এথনিক সম্প্রদায়ের উপর যেখানেই হামলা হয়েছে নির্মূল কমিটির সদস্যরা সেখানে ছুটে গিয়েছেন। বিপন্ন মানুষকে তারা সাহস জুগিয়েছেন, সামাজিক প্রতিরোধ সংগঠিত করেছেন। হামলাকারীদের গ্রেফতারের জন্য প্রশাসনকে চাপ দিয়েছেন। বিভিন্ন স্থানে সাধ্যমতো আর্থিক ও আইনি সহযোগিতাও প্রদান করেছেন। এর সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে ২০১৬-এর শেষের দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগরের ঘটনা। যখন বন্দী, ভুক্তভোগী রসরাজ দাসের পাশে দাঁড়াবার জন্য কোনও আইনজীবী পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নির্মূল কমিটির ছয়জন আইনজীবী নিরীহ, নিরাপরাধ রসরাজের পক্ষে দাঁড়িয়ে আইনি লড়াই চালিয়ে অবশেষে ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি তাকে কারাগার থেকে বের করে এনেছেন।

২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন দেশে অর্ধ শতাধিক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সেমিনার ও সম্মেলনে যোগ দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের যৌক্তিকতা যেমন তুলে ধরেছেন, একইভাবে ধর্মের নামে বিশ্বব্যাপী যে মৌলবাদী সন্ত্রাস মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, যেভাবে নিরীহ মানুষ নিহত হচ্ছে, দেশান্তরিত ও নিখোঁজ হচ্ছে, যেভাবে শতশত জনপদ এবং মানবসভ্যতার নিদর্শন ধ্বংস হচ্ছে তার বিরুদ্ধে সমন্বিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথাও বলেছেন। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিষয়ক ২ দিন ব্যাপী আঞ্চলিক সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্য ২০১৭ সালের জানুয়ারির শেষের দিকে বিচারপতি এ এইচ শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের নেতৃত্বে নির্মূল কমিটির ৭ জন কেন্দ্রীয় নেতা ভারতে যান। এর বাইরেও দিল্লী ও কলকাতায় তিনটি আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করেন যা আয়োজন করছে নির্মূল কমিটির পশ্চিমবঙ্গ শাখা ও সমমনা বন্ধুরা।

শহীদজননী জাহানারা ইমাম ও শাহরিয়ার কবির- নির্মূল কমিটির এই দুই প্রতিষ্ঠাতার উদ্যোগে ১৯৯২ সাল থেকেই বহির্বিশ্বে নির্মূল কমিটির আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। ‘৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতেই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মান শাখা গঠিত হয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্য এবং ইউরোপের ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, সুইডেন, ইতালি, সুইজারল্যাণ্ড, ডেনমার্ক, বেলজিয়াম এবং অস্ট্রেলিয়ায় নির্মূল কমিটির শাখা গঠিত হয়েছে। ২০১২ সালে শাহরিয়ার কবিরের উদ্যোগে পাকিস্তানেও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির শাখা গঠিত হয়েছে। বহির্বিশ্বে নির্মূল কমিটির সর্বশেষ শাখা গঠিত হয়েছে অস্ট্রেলিয়া ও ফিনল্যান্ডে ২০২০ সালে । বহির্বিশ্বে নির্মূল কমিটির সবচেয়ে সক্রিয় শাখা যুক্তরাজ্য। তারপরই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও সুইডেন, যে শাখাগুলো নিয়মিতভাবে সেসব দেশের আইনপ্রণেতা, বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকার সংগঠন ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার এবং জঙ্গী মৌলবাদের বিরুদ্ধে বক্তব্য তুলে ধরে আন্তর্জাতিক জনমত সংঘটিত করেছে এবং করছে। সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি- সর্বক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন না ঘটানো পর্যন্ত নির্মূল কমিটির এই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।

২০১৭ সালের ১৯ জানুয়ারি ৩ দিন ব্যাপী জাতীয় সম্মেলন ও রজতজয়ন্তী আয়োজন উদ্বোধন করেছেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব মো. আবদুল হামিদ। আন্দোলনের সাফল্য কামনা করে মহামান্য রাষ্ট্রপতি তার ভাষণে বলেছেন- ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ার সংগ্রামে আগামী দিনগুলোতে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে- এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করে আমি এই সংগঠনের রজতজয়ন্তী ও ৭ম জাতীয় সম্মেলনের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করছি।’ মহামান্য রাষ্ট্রপতি ছাড়াও সম্মেলনের বিভিন্ন অধিবেশনে জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পীকার এবং মন্ত্রীসভার সম্মানিত সদস্যবৃন্দ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ আন্দোলনের সাফল্য কামনা করে বক্তব্য প্রদান করেছেন।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র রজতজয়ন্তীর বছরে ‘৭১-এর গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং তাদের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের আন্দোলনের অন্যতম অর্জন হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণ করা এবং শ্রদ্ধা জানাবার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি দিবস নির্ধারণ করা। গত দুই যুগেরও অধিককাল নির্মূল কমিটি ২৫ মার্চ গণহত্যার কালরাত্রি পালনের পাশাপাশি সরকারের নিকট এই দিনটিকে জাতীয় গণহত্যা দিবস ঘোষণার জন্য দাবি জানিয়েছে। অবশেষে ২০১৭ সালের ১১ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, মাননীয় বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বিশেষভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করার ফলে জাতীয় সংসদে সর্বসম্মত প্রস্তাবের পর সরকারিভাবে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস ঘোষিত হয়েছে।

প্রথমবার সরকারিভাবে গণহত্যা দিবস ঘোষণার পর ২০১৭ সালের ২৫ মার্চ দেশে ও বিদেশে নির্মূল কমিটির অধিকাংশ শাখা যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে দিবসটি পালন করেছে। এর ভেতর জাতীয় পর্যায়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব আবদুল হামিদ ২৫ মার্চ নির্মূল কমিটির পূর্বঘোষিত কর্মসূচি- মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লক্ষ শহীদের স্মরণে ৩০ লক্ষাধিক বৃক্ষরোপণের বিশাল কর্মযজ্ঞ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেছেন। নির্মূল কমিটির এই ব্যতিক্রমধর্মী কর্মসূচি সফল করবার আহ্বান জানিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ২৫ মার্চে বঙ্গভবনে আয়োজিত নির্মূল কমিটির সমাবেশে প্রধান অতিথির ভাষণে বলেন- ‘আজ ২৫ মার্চ বঙ্গভবনের সবুজ চত্বরে ২৫টি বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে ‘শহীদস্মৃতি বৃক্ষরোপণ’ কর্মসূচির শুভ সূচনা হতে যাচ্ছে। গণহত্যায় শহীদদের স্মরণ করার পাশাপাশি গণহত্যাকে নিরুৎসাহিত করার ক্ষেত্রে এ উদ্যোগ দেশ-বিদেশে জনমত ও জনসচেতনতা সৃষ্টি করবে বলে আমার বিশ্বাস। আমরা চাই না বিশ্বে আর কোনো গণহত্যা সংঘটিত হোক, মানবতার বিপর্যয় হোক। আমরা চাই বিশ্বশান্তি, মানবতার মুক্তি।’ বঙ্গভবনে নির্মূল কমিটির শহীদস্মরণে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের ঠিক পরপরই জাতীয় প্রেস ক্লাব ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুরূপ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে। সেখানে নির্মূল কমিটির নেতৃবৃন্দ ও শহীদ পরিবারের সদস্যবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এর পরের দশ দিন সারা দেশে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও বধ্যভূমিতে নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে এই কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।

নির্মূল কমিটি গত কয়েক বছর ধরে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং ‘৭১-এর গণহত্যাসহ মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃত ইতিহাস অস্বীকারকারীদের শাস্তির জন্য ইউরোপের ‘হলোকস্ট ডিনায়াল অ্যাক্ট’-এর মতো কঠোর আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়ে আসছে। নির্মূল কমিটির অনুরোধে গত বছর আইন কমিশন এই আইনের খসড়া আইন মন্ত্রণালয়কে পাঠিয়েছে। আইনটি রচনার ক্ষেত্রে নির্মূল কমিটি আইন কমিশনকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করেছে। এই আইনের পাশাপাশি নির্মূল কমিটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাজাপ্রাপ্ত গণহত্যাকারীদের যাবতীয় স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের পরিবার, নির্যাতিত নারী এবং অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে ব্যয় করার জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ণের কথাও বলেছে।

মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী এবং তাদের মগ সহযোগীরা রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর যে পরিকল্পিত গণহত্যা আরম্ভ করেছে তার কারণে ৬ লক্ষাধিক অসহায় ও বিপন্ন রোহিঙ্গা সর্বস্ব হারিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। ২০১৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র পক্ষ থেকে রাজধানীতে ‘রোহিঙ্গা গণহত্যার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান: সরকার, নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রদায়ের করণীয়’ শীর্ষক একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়। সেমিনারে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীসহ বিশিষ্ট মানবাধিকার নেতা, কূটনীতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা উপস্থিত ছিলেন। সংগঠনের সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সেমিনারে পাঁচটি প্রস্তাব গৃহীত হয়, যার অন্যতম ছিল ‘মিয়ানমারে গণহত্যা ও সন্ত্রাস তদন্তে নাগরিক কমিশন’ গঠনের উদ্যোগ।

‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে অতুলনীয় অবদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর বরেণ্য বিদেশী নাগরিকদের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত আট দফায় প্রায় ৩০০ জন বরেণ্য বিদেশী নাগরিককে এই সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। নির্মূল কমিটি তাদের কয়েকজনের নামে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের নামকরণের প্রস্তাব করে। সড়কের নামকরণের ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাজধানী ঢাকার মর্যাদা বৃদ্ধি করবে বলে নির্মূল কমিটির নেতৃবৃন্দ তা বাস্তবায়নের দাবি জানান। এ ক্ষেত্রে নির্মূল কমিটি সরকারকে সবরকম সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। মেয়র আনিসুল হক এ বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে কথা দিয়েছিলেন ২০১৭ সালের বিজয় দিবসের আগেই এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন করবেন। বেঁচে থাকলে তিনি অবশ্যই এ দাবি পূরণ করতেন বলে নির্মূল কমিটি বিশ্বাস করে। ভারতের রাষ্ট্রনায়ক শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর জন্মশতবার্ষিকীতে সরকারের নিকট নির্মূল কমিটি দাবি জানায় রাজধানীর একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক তার নামে রাখার জন্য।

গত তিন দশকে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ শুধু বাংলাদেশে নয়, বহির্বিশ্বেও নাগরিক আন্দোলনের আইকনে পরিণত হয়েছে। নির্মূল কমিটি সংগঠন থেকে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। নির্মূল কমিটি বাংলাদেশে এবং দেশের বাইরেও মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী নাগরিক আন্দোলনের তত্ত্ব নির্মাণের পাশাপাশি রাজপথে নেতৃত্ব দিচ্ছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই আন্দোলন সম্পর্কে উচ্চতর গবেষণা হচ্ছে। বিদেশ থেকে গণমাধ্যমকর্মী ও গবেষকরা আসছেন এই আন্দোলন সম্পর্কে জানার জন্য। এই আন্দোলন সম্পর্কে দেশে ও বিদেশে বেশ কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্রও নির্মিত হয়েছে। প্রতি বছর নির্মূল কমিটির নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমন্ত্রিত হচ্ছেন।

সম্প্রতি কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙ্গার প্রতিবাদে যখন দেশের বুদ্ধিজীবীরা নীরব তখন নির্মূল কমিটি ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর ৬০টি সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমন্বয়ে ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউটের সামনে মানববন্ধনের আয়োজন করে। মানববন্ধন থেকে কঠোর ভাষায় ভাস্কর্য ভাঙ্গার প্রতিবাদ জানানো হয়। ২৯ বছরের আন্দোলনের ভেতর দিয়ে নির্মূল কমিটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত একটি প্রজন্ম সৃষ্টি করতে পেরেছে। আন্দোলনে যৌথ নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে কেন্দ্র থেকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবিতে নির্মূল কমিটির যাত্রা শুরু হয়েছে এবং শীর্ষ মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকরের মাধ্যমে আন্দোলনের সফলতা এসেছে। এখন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য নির্মূল কমিটি কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর, নির্মূল কমিটির ২৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এবং মুজিববর্ষে বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে এই প্রত্যাশা।

নির্মূল কমিটি: অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ২৯ বছর – তপন পালিত – ১৯ জানুয়ারি ২০২১

মন্তব্যসমূহ
বই পড়তে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি' এ্যাপটি ব্যবহার করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button