বই-দলিলপত্র-প্রবন্ধ
Trending

মুক্তিযুদ্ধে মেজর জিয়া – অধ্যাপক আবু সাইয়িদের রচনা থেকে নেয়া

বই পড়তে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি' এ্যাপটি ব্যবহার করুন।

কোলকাতার হেয়ার স্কুলে জিয়াউর রহমানের ছাত্র জীবন শুরু। ১৯৪৭ সনে ভারত বিভাগের সুবাদে চাকুরীজীবী পিতা মনসুর রহমান সপরিবারে পূর্ব বাংলায় ‘অপশন’ না দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচী চলে যান। জিয়ার বয়স তখন মাত্র বারাে বছর।

পূর্ব বাংলায় যখন ভাষা আন্দোলন একটি বিশেষ পর্যায় অতিক্রম করছে, ৫২ সনের ২১শে ফেব্রুয়ারী সালাম বরকত রফিক জব্বার ভাষার লড়াইয়ে যখন বুকের রক্ত ঢেলে দিচ্ছে, সারা বাংলায় ভাষার লড়াই যখন গ্রাম পর্যন্ত প্রসারিত, তখন উঠন্ত কিশাের জিয়াউর রহমানকে এর কিছুই স্পর্শ করতে পারেনি। শ্যামলঘন বাংলাদেশের আবহাওয়া পরিবেশের বাইরে উষর রুক্ষ ধূসর করাচীর একাডেমী স্কুলে আবশ্যিক ভাষা উর্দু রপ্ত করার চেষ্টায় রত জিয়াউর রহমানের পক্ষে ভাষা আন্দোলনের চেতনা ও মর্মবাণী ধারণ করা কোনক্রমেই সম্ভব ছিলােনা।

১৯৫২ সনে ২য় বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন ডি,জে, কলেজে।

১৯৫৩ সালে পাকিস্তান সামরিক একাডেমীতে একজন অফিসার ক্যাডেট হিসেবে তিনি বিশেষ কমান্ডাে ট্রেনিং লাভ করেন। ঐ কলেজে ও একাডেমীতে পরিবেশগত পরিমন্ডল এমনই ছিলাে যে, “খাঁটি পাকিস্তানী’ না হলে ঐ কলেজে ঢােকা একজন বাঙালীর পক্ষে সম্ভব ছিলাে না। জিয়াউর রহমানের সুবিধা ছিলাে এই যে, তাকে কখনাে বাংলা বলতে হয়নি এবং বাঙালী বলে পরিচয় দেওয়াকে তার একেবারেই ছিলাে অপছন্দ। এই অপছন্দের দিকটিই তার চাকুরীর ক্ষেত্রে পদোন্নতির বিশ্বস্ত মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। একজন ‘খাঁটি পাকিস্তানী” হিসেবে তার গায়ে ‘বাঙালী’ বা ‘প্রাদেশিকতার গন্ধ না থাকায় পাকিস্তানী সামরিক অধিনায়কদের পছন্দের লােক হতে তার কোন অসুবিধা হয়নি। অনেকেই তার কথায় ও কণ্ঠস্বরে উর্দু বাচন ভঙ্গীর যে আমেজ লক্ষ্য করেন, তাদের হয়ত অজানা যে, জিয়াউর রহমান যে স্কুলে বা কলেজে অধ্যয়ন করেছেন, সে সব প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষা তার পাঠক্রমে অন্তর্ভূক্ত ছিলােনা।

কিশাের জীবনের মানস গঠনের প্রাক্কালে পিতার চাকুরীসূত্রে বাঙালী সমাজ হতে বিচ্ছিন্ন, আত্মীয় পরিজন হতে ছিটকে পড়া এবং বাংলাদেশের নিসর্গ চেতনার বিপরীতে একটি ভিন্ন পরিবেশ ও পরিস্থিতির মধ্যে জিয়াউর রহমানের শৈশব জীবন শুরু। করাচী একাডেমী স্কুলে ভিন্ন ভাষা ও ভিন্ন আচরণগত দিকের সঙ্গে খাপ খেতে গিয়ে এবং তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার প্রতিযােগিতায় জিয়ার কিশাের জীবনে বাঙালীত্বের মানস গড়নে গড়ে ওঠেনি।

তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে যখন উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভূক্ত করার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠছে এবং আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে – সেই সময়ে তাকে পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু ভাষাভাষী অঞ্চলে সহি উর্দু শিক্ষার অনুশীলন করতে হয়েছে এবং রপ্ত করতে হয়েছে সহি উর্দু জবান। অর্থাৎ বাঙালি হয়েও বাংলা ভাষার পাঠ তার পক্ষে গ্রহণ সম্ভব হয়নি, বাঙালির মানস চেতনার মর্মবাণী উপলদ্ধি হতে দূরে থাকতে হয়েছে।

করাচী একাডেমী স্কুলের পরিমন্ডলে বাঙালী সংস্কৃতি সম্পর্কে নেতিবাচক ব্যাতীত ইতিবাচক ধারণা পাওয়া সম্ভব ছিলাে না। সেই অবস্থায় জিয়াউর রহমান পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানান সই করতে গিয়ে বেশী করে বাঙালিদের এড়িয়ে চলেছে, বাঙালি সংস্কৃতি ও জীবন চর্চার বাইরে তাকে দূরে থাকতে হয়েছে। অদৃশ্য ভিলেনের সুবিধাবাদী ভূমিকাই বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তার ভাগ্য উন্নয়নের পশ্চাতে কাজ করেছে। সুযােগ বুঝে নিজের যুৎসই অবস্থান নিতে তার ভুল হয়নি।

লক্ষ লক্ষ মানুষের গৌরবময় আত্মত্যাগ এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্টিত হওয়া এক বিস্ময়কর ঘটনা! আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, জিয়াউর রহমানের উথান আকস্মিক ঘটনাসমূহের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফলশ্রুতি। মনে হতে পারে, নীরব দর্শক, ক্ষমতার পরিমন্ডল হতে দূরে থাকা নির্লিপ্ত নৈর্ব্যক্তিক জিয়াউর রহমানকে আকস্মিক ঘটনার ঘনঘটা ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে টেনে এনেছে, এতে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা নেই, যতটা না আছে ঘটনাসমূহের সক্রিয়তা। এক কথায় বিষয়টি এরূপ নয়।

জিয়াউর রহমানের জীবনাচারণ, তার কর্মপদ্ধতি, পেশাগত প্রশিক্ষণ আচরণগত দিক বিশ্লেষণ করলে এবং ভিন্ন ভিন্ন বিভক্ত ঘটনাসমূহের যােগফল ধারণাকৃত কথার সত্যতা প্রমাণ করেনা। বরং গভীর পর্যবেক্ষণে ঘটনার পরম্পরার মধ্যে তার বিশেষ ভূমিকা-যা সূক্ষ, অথচ কার্যকর, কখনও সরব এবং নীরব উপস্থিতি ঘটনাসমূহের জন্ম দিয়েছে এবং একটি মােক্ষম সময়ে ঘটনার অঙ্গনে তিনি নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। স্বল্পবাক, নেপথ্যচারী এই মানুষটি ঘটনা সংঘটনের পূর্বে ‘অদৃশ্য ভিলেনের ভূমিকায় অবতীর্ণ এবং ঘটনার সফলতায় ‘নায়কের বীরােচিত ভঙ্গিমায় দর্শকদের সামনে উপস্থিত হয়েছেন; কৈশােরের পরিবেশ ও প্রাথমিক চাকুরী জীবন তাকে এই মানসিকতায় ঠেলে দিয়েছে।

কর্মজীবনের প্রাথমিক অবস্থায় এমনকি, স্বাধীনতার যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত জিয়াউর বহমান তার সম সাময়িক বাঙালী অফিসারদের সচেতনভাবে এড়িয়ে চলার অভিযােগের উত্তর তার প্রাথমিক জীবন গড়নের মধ্যেই ছিলাে নিহিত। বাঙালী অফিসারদের এড়িয়ে চলার মধ্যে এটাও স্বাভাবিক কারণ হয়ে থাকবে যে, সামরিক কমান্ডে এবং সামরিক জীবনে চাকুরী এবং বৈষয়িক সুযােগ-সুবিধা প্রাপ্তির সােনার চাবি’টি ছিলাে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনা অফিসারদের হাতে। সেই কারণে জিয়াউর রহমান তার চলনে বলনে আচার আচরণে চিন্তা চেতনায় একজন ‘শুদ্ধতম পাকিস্তানী হিসেবে গড়ে ওঠার সামান্য সুযােগটুকুও হাতছাড়া করেননি। পাকিস্তানী সামরিক কর্তাদের আস্থাভাজন হওয়ার ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের নিরলস প্রচেষ্টার ‘দাসানুগ আচরণ’ তদানন্তিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালী সামরিক অফিসারদের অনেকের নিকট দৃষ্টিকটু হলেও এ ক্ষেত্রে তাদের করার কিছুই ছিলনা। বাঙালীদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ প্রভুভক্ত গর্বোন্ধ এই তরুণ সামরিক অফিসারটি গােপন সার্ভিস রেকর্ডের মাধ্যমে অতি স্বল্প সময়েই কর্তাব্যক্তিদের নজরে আসতে সমর্থ হন। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকগােষ্ঠীও বাঙালি রাজনীতিবিদ, আমলা, সামরিক অফিসারদের মধ্যে হতে তাদের একান্ত অনুগত ‘বাধ্যানুগত’ ‘বিশ্বস্ত’ ‘বশংবদ সৃষ্টি চেষ্টায় সর্বদাই তৎপর ছিলাে। সামরিক ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের এডুকেশান ব্যাকগ্রাউন্ড ও পাকিস্তানী প্রীতির দৌলতে এবং সামরিক কর্মকান্ডে তার স্বাভাবিক নিয়মনিষ্ঠ আচার আচরণ ইত্যাদি মিলিয়ে ক্যাপ্টেন জিয়া অচিরেই পাকিস্তানী সামরিক অধিনায়কদের প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন।

সেজন্য লক্ষ্যণীয়, ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারীর পর পরই বাঙালি রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ছাত্রদের সম্পর্কে গােপন রিপোর্ট প্রদানের দায়িত্বে জিয়াউর রহমানকেই জেনারেল আইয়ুব খান বেছে নিতে ভুল করেনি। ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারীর পর ১২ই অক্টোবর মওলানা ভাসানী কারারুদ্ধ হলেন এবং ১৯৬২ সালের ৩রা নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকা ধানমন্ডির আবাসিক এলাকায় ভাড়া বাড়িতে তাকে অন্তরীণ রাখা হলাে। তার স্ত্রী ও সন্তানগণ সরকারী খরচে তার সঙ্গেই থাকেন।

কিন্তু ১৯৫৮ সালের ১২ই অক্টোবর শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে দেশরক্ষা আইনে তাঁকে নিরাপত্তা বন্দী হিসেবে কারারুদ্ধ করা হয়। তার বিরুদ্ধে একের পর এক নয়টি মামলা সাজানাে হয়। সবগুলােতে বেকসুর খালাস পেয়ে ১৯৫৯ সালের ১৭ই ডিসেম্বর তিনি মুক্তি পান। তবুও তার উপর কড়া বিধি-নিষেধ আরােপিত থাকে। সামরিক শাসন জারী হওয়ায় পরপরই হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের গ্রেফতার করা হয়। রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ থাকে।

এই অবস্থার মধ্যে জেনারেল আইয়ুব খান বিশ্ববাসীকে ধােকা দেবার লক্ষ্যে ১৯৫৯ ডিসেম্বর সমগ্র পাকিস্তানে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করেন। কেননা ঐ নির্বাচন জেনারেল আইয়ুব খানের জন্য বিশেষ জরুরী ছিলাে। সেটা হলাে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি অর্থাৎ ইউনিয়ন কাউন্সিল সদস্যদের আস্থাভােট লাভ। সামরিক আইন বিধি অনুযায়ী ভােটদাতাদের কেবলমাত্র হা বা না বলার ক্ষমতা দেয়া হয়েছিলাে। সামরিক শাসনে গণভােট-এর তালিম জিয়াউর রহমান-এর মানসপটে অংকিত হয়ে যায় । এই প্রেক্ষিতে সামরিক গােয়েন্দা দপ্তরকে আইয়ুবের পক্ষে কাজ করার দায়িত্ব অপর্ণ করা হয়। জিয়াউর রহমান এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সামরিক গােয়েন্দা বাহিনীর কর্মকর্তা হয়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে পােস্টিং পান। সামরিক গােয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুবের কর্মকান্ডের সফল বাস্তবায়নে বিশেষ গুরুত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমান পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেন।

৫৫ সনে কমিশন প্রাপ্ত হয়ে জিয়াউর রহমান প্রায় দু বছর পাঞ্জাব রেজিমেন্টে কর্তব্যরত থাকা কালে পাঞ্জাবী সামরিক কর্তৃপক্ষের আরাে বিশ্বস্ততা অর্জন করেছিলেন। তারই ফলশ্রুতিতে ৫৯ সনে সামরিক গােয়েন্দা বিভাগের দায়িত্ব নিয়ে তাকে বেশ কিছুদিন দিনাজপুরে অবস্থান করতে হয়।

দিনাজপুরেই অষ্টম শ্রেণীতে স্কুলগামী বেগম খালেদার সঙ্গে তার পরিচয় এবং পরিণয়। বিয়ের বেশ কিছু মাস পর তদানীন্তন শাহবাগ হােটেলে (এখন পিজি) বৌ-ভাত অনুষ্ঠিত হয়। সামরিক শাসনের অধীনে অতিথি আপ্যায়নের বিধি জিয়াউর রহমানের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য হয়নি।

৫৯ সন ৬৪ সন পর্যন্ত জিয়াউর রহমান তদানন্তিন পূর্ব পাকিস্তানের গােয়েন্দা সংস্থার কর্তা ব্যক্তি হিসেবে কাজ করেন। ৬২-৬৪ সালের রাজনৈতিক ঘটনাবলীর উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখার জন্য বাঙালী হয়ে বাঙালীদের বিরুদ্ধে এক পােক্ত পেশাদার গােয়েন্দা ব্যক্তিত্ব হিসেবে জিয়াউর রহমান সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন সন্দেহ নেই। রঙিন চশমার অন্তরালে নিজের চোখকে অন্যের থেকে আড়াল করে অন্যকে দেখার মধ্যে যে চৌর্য-চাতুরতা নিহিত সে সময় হতেই জিয়ার নিকট ছিলাে উপভােগ্য এবং সমগ্র জীবনে তার এই অভ্যাসের ছেদ পড়েনি।

৬৫ সনে পাকভারত যুদ্ধে ফার্স্ট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ভূমিকা উল্লেখযােগ্য। ঐ রেজিমেন্টের কমান্ডার অফিসার ছিলেন কর্ণেল এ,টি, কে, হক। তার অধীনে ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমান একজন কোম্পানী কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ঐ যুদ্ধে ফার্স্ট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী হয় এবং পদাতিক বাহিনীর উপসকে বীরত্বের জন্য পদক দেয়া হয়। জিয়া অনুসারীরা পাক ভারতের যুদ্ধে জিয়াউর রহমানের বীরত্বের কথা মাঝে মধ্যে টিভিতে প্রচার করার প্রয়াস নিলেও দুঃখজনক হলেও সত্য যে, জিয়াউর রহমান ঐ যুদ্ধে তেমন কোন কতিত্বের দাবীদার ছিলেন না। বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের জন্য জিয়া বীরত্বপূর্ণ পদক পাননি। নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করার জন্য সার্ভিস এওয়ার্ড পেয়েছিলেন মেজর জেনারেল সাদেক যিনি সেদিন ছিলেন কোয়ার্টার মাস্টার।

যুদ্ধের পরে জিয়াউর রহমান মেজর পদে উন্নীত হন এবং ৬৬-এ কাকুলে পাকিস্তানের মিলিটারী একাডেমীর প্রশিক্ষক নিযুক্ত হন। ৬৭-সনে পি এস সি প্রাপ্ত হন এবং ৬৯ সনে সেকেন্ড বেঙ্গলে যােগদান করেন। মেজর সফিউল্লাহর কারনে জিয়ার সেকেন্ড বেঙ্গলে যােগদান দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ব্যাটেলিয়ানে থাকার চেয়ে রহস্যময়তার হাতছানি জিয়াউর রহমানকে পুনরায় টেনে নিয়ে যায়।

৬৯ সনে জার্মানীতে তিন মাসের ট্রেনিং-এ চলে যান। সি আই এ নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্রিটিশ অফিসার রেভারাইন ট্রেনিং জিয়াউর রহমানের মানসে গােয়েন্দা চেতনা পূর্ণতা লাভে সহায়তা করে।

প্রশিক্ষণের পর জিয়াউর রহমান পূর্ব পাকিস্তানে বদলি হন এবং ৮ম বেঙ্গলের সেকেন্ড ইন কমান্ডের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জিয়াউর রহমানের জন্য এই বদলী তার ভবিষ্যৎ জীবন রচনার ক্ষেত্রে এবং পরবর্তীকালে রাষ্ট্রের শীর্ষস্থান দখলের ক্ষেত্রে এক অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালন করেছে।

অক্টোবরে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পশ্চিম পাকিস্তানে বদলী করা হয় এবং একই সঙ্গে জিয়াউর রহমানও বদলীর আদেশ প্রাপ্ত হন।

৭০-এর জাতীয় নির্বাচনের পর পরই ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রায় অর্ধেক সংখ্যক সেনা অফিসার করাচীর উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম ত্যাগ করে। জিয়াউর রহমানের সৌভাগ্যই বলতে হবে যে, বাকী অর্ধেক অর্থাৎ মাত্র ৩০০ মত সৈন্য নিয়ে চট্টগ্রাম ত্যাগের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে।

সে সময়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। নির্বাচনের পর পরই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর জেনারেলগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, কোনভাবেই বাঙালীদের হাতে, বিশেষ করে শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ শুধু পূর্ব পাকিস্তানে নয়, সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্টতা অর্জন করে। নির্বাচনী রায় বানচাল করার লক্ষ্যে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। পাশাপাশি বাঙালী জাতির অবিসংবাদী নেতা ও জাতীয় আশা আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সতর্ক ও কৌশলের মাধ্যমে জনগণের হত অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সমগ্র বাঙালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে ষড়যন্ত্র মােকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

জিয়াউর রহমান মেজর খালেদ মােশাররফ ও মেজর রফিককে বারবার নিরস্ত করতে গিয়ে বলেছেন, ‘ঘাবড়াবার কিছু নেই। ওরা অতদূর যাবেনা। অর্থাৎ পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী বাঙালী সেনা অফিসারদের উপর আক্রমণ করবে না। অথচ মেজর খালেদের কথা ছিলাে, ওরা আমাদের উপর আঘাত হানবেই। আমাদের উপর আঘাত আনার আগেই আমাদেরকে তাদের উপর আঘাত হানতে হবে-তা না হলে ওরা সবাই আমাদেরকে জবাই করে ফেলবে।

জিয়াউর রহমানের বিশ্বাসই ছিলােনা যে, সত্যি সত্যি পাকিস্তানীরা তাদের উপর আক্রমণ করতে পারে। সেজন্য ২৬শে মার্চ মেজর জিয়া চট্টগ্রাম বন্দরে এম ভি সােয়াত থেকে অস্ত্রসস্ত্র গােলাবারুদ নামানাের কাজে সাহায্য ও তদারকি করার জন্য রওনা হন। পথিমধ্যে জানতে পারেন পাকিস্তান আর্মি ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে বহু সেনা অফিসার হত্যা করেছে। তখন জিয়াউর রহমান সটকে পড়েন।

জিয়াউর রহমান যখন চট্টগ্রাম হতে পটিয়ার দিকে রিট্রিট করেন সে সময় মেজর রফিক বিপদ ও ঝুঁকি সত্ত্বেও বীরত্বের সঙ্গে চট্টগ্রামে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। ১৯৭১ সনে ২৫শে মার্চ জিয়াউর রহমান প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করে হিরাে বনে যান। জিয়ার কোন যুদ্ধ পরিকল্পনা ছিল না।

২৪ শে মার্চ হতে পি-আই-এর বিমানে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতারা ঢাকা ত্যাগ করতে থাকেন। জেনারেল ফরমান আলী ও জেনারেল খাদেম রাজা দুটি হেলিকপ্টারে করে ঢাকার বাইরে বিগ্রেড কমান্ডারদের, ‘অপারেশন সার্চলাইট’ সম্পর্কে ব্রিফ করার জন্য বেরিয়ে পড়েন। সামরিক বাহিনীর বটল গ্রীন কালারের একটি হেলিকপ্টার নিয়ে জেনারেল খাদিম রাজা চট্টগ্রাম নামলেন। বললেন: জয়দেবপুর সেকেন্ড ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে এক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। তার জন্য ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে জয়দেবপুর যাওয়া বিশেষ প্রয়ােজন। বিগ্রেডিয়ার মজুমদারকে ঢাকায় নিয়ে আসা হলাে। তাকে নজরবন্দী রাখা হলাে। চট্টগ্রামের দায়িত্ব দেয়া হলাে লেঃ কর্ণেল ফাতমীর উপর এবং বিগ্রেডিয়ার ইকবাল শাফীকে দায়িত্ব নেবার জন্য অর্ডার দেয়া হলাে। তার আসতে কয়েকদিন সময় লাগবে। কেননা তিনি তখন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে। কিন্তু তার দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বেই ১৭শে মার্চ অপারেশন সার্চ লাইটের গ্রীন সিগন্যাল চলে এলাে। তখন চট্টগ্রামে ই বি আর, ই পি আর, নতুন ই বি আর সি ও পুলিশ মিলিয়ে বাঙালীর সশস্ত্র শক্তি প্রায় ২০ হাজার। অন্যদিকে চট্টগ্রামে বিশ বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্য সংখ্যা মাত্র ৬০০ জন। বিগ্রেডিয়ার মজুমদারকে ঢাকায় আনার পর ৮ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট-এ মেজর জিয়াউর রহমান সেকেন্ড ইন কমান্ড। এত বড় সৈন্য শক্তি হাতে থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতা যুদ্ধে যােগদানের পূর্ব ইচ্ছা, পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত এবং সমন্বয়ের অভাবে চট্টগ্রাম দখল করা ‘বীর’ জিয়াউর রহমানের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এমনকি এই বিরাট শক্তি সমন্বয়ে যেভাবে প্রতিরােধ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিলাে তা হয়নি।

ক্যাপ্টেন রফিক ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে জনশক্তি তৈরী হয়েছিলাে সামরিক নেতৃত্বের অভাবে তাদের দ্বারা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। তবুও চট্টগ্রামের যুদ্ধ পাকিস্তানী সামরিক জেনারেলদের বিব্রত ও ব্যাতিব্যস্ত করে তুলেছিলাে। রিজার্ভ পুলিশ লাইনে বিশ হাজার রাইফেল রক্ষিত ছিলাে, জনগণ তা নিজের হাতে তুলে নেয়। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ৮ম ইবি বি আর পাকবাহিনীর সংগে সরাসরি যুদ্ধ মােকাবিলার সময়, সুযােগ ও সমন্বয়ের সময় পায়নি।

মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্ণেল আতাউল গনি ওসমানী একান্ত সাক্ষাৎকারে নির্দ্বিধ চিত্তে বলেছেন, “পাকিস্তানীরা যদি তাদের আক্রমণ কেবল মাত্র নির্দিষ্ট কয়েক জন রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে সীমিত রাখতাে তাহলে বাঙালী সৈনিক ও পুলিশরা হয়তাে নিরপেক্ষ ভূমিকাই পালন করতাে। যখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্বিচারে বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালী সদস্যদেরও হত্যা করার খবর ছড়িয়ে পড়লাে, কেবলমাত্র তখনই আমরা একদেহে প্রতিরােধ গড়ে তুললাম। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই আক্রমণের মাধ্যমে রাতারাতি এভাবে মুক্তি বাহিনীর সৃষ্টি করলাে।”

বস্তুতঃ বাঙালী সেনাবাহিনীকে বিভক্ত করাে ও আঘাত করাে নীতিতে পাকিস্তানী কার্যক্রম শুরু হলে বাঙালী সেনা অফিসারগণ আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হন। কিন্তু অবস্থার প্রেক্ষিতে, সংগ্রামী জনতার চাপে ও জনগণের আকাঙ্খার সংগে সংগতি রক্ষার্থে কার্যক্ষেত্রে তাদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে যুদ্ধে অংশগ্রহণ ব্যতীত বিশেষ কোন উপায় ছিলাে না। পাকিস্তানী সেনা কাঠামাের মধ্যে বেড়ে ওঠা বাঙালী সেনা আফসার ও অধিকাংশ সদস্যদের মনে পাকসামরিক বাহিনীর নৃশংসতা, শক্তি সম্পর্কে কোনই অস্পষ্টতা ছিলাে না, ফলে ধরতে গেলে অসম যুদ্ধের। পরিণতি সম্পর্কে তারা ছিলেন সতর্ক, ফলে সীমান্তের দিকে দ্রুত গতিতে ধাবিত হতে তাদের সিদ্ধান্তে অস্পষ্টতা ছিলাে না।

চট্টগ্রামের জনগণ, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী বিএলএফ সদস্য, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, প্রাক্তন সামরিক বাহিনীর সদস্যগণ যখন সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত তখন মেজর জিয়া যুদ্ধে ময়দান ছেড়ে ও সামরিক দায়িত্ব পালন না করে রাজনীতিবিদদের ন্যায় আচরণ প্রদর্শন করেন। কালুরঘাটে বেতার ভাষণে নিজেকে হেড অব দি স্টেট হিসেবে ঘােষণা করছেন এবং অবস্থার বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করেছেন, সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে ঘােষণা দিয়ে পরে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন।

যখন কালুর ঘাটে যুদ্ধ হচ্ছে, জিয়াউর রহমান তখন কক্সবাজারের ট্রেজারী হতে প্রাপ্ত টাকার হিসাব মেলাতে ব্যস্ত। যখন কক্সবাজারে যুদ্ধ জিয়া তখন রামগড়ে, যখন রামগড়ে যুদ্ধ তখন জিয়াউর রহমান ভারতীয় সীমান্ত অভ্যন্তরে নির্বিঘ্নে অবস্থান নিয়েছেন। সেজন্য যুদ্ধের সময় জিয়াকে অনেকেই ‘মেজর রিট্রিট’ হিসেবে সম্বােধন করতেন।

২৫মে মার্চ বেলা একটা। ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে আরাে দুটি প্লাটুনকে সােয়াত নামের জাহাজ থেকে অস্ত্রশস্ত্র খালাসের জন্য পাঠানাে হয়। আগের দিন ৫০ জন বাঙালী সৈন্যকে নিরস্ত্র অবস্থায় অস্ত্র খালাসের জন্য পাঠানাে হয়েছিলাে। ২৬শে মার্চ সকাল ১০টা পর্যন্ত তাদের দিয়ে মাল খালাস করা হয়। তাদের খাবার দেয়া হলাে না। ক্যান্টনমেন্টে ফেরার অনুমিত দেয়া হলাে না। সােয়াত জাহাজে তাদের আটকে রাখা হলাে।

তার পরের ঘটনা ২৭শে মার্চ ১৯৭১। হতভাগ্য বন্দী বাঙালী সৈন্যদের সােয়াত জাহাজ থেকে বের করে এনে দাঁড় করানাে হলাে জেটির প্লাটফর্মে। সবাই দু’হাত তুলে আত্মসমর্পনের ভঙ্গীতে দাড়ালাে। তবু চালানাে হলাে গুলি। মুহুর্তে লুটিয়ে পড়লাে। বাঙালী সেনা সদস্যদের দেহ। থকথকে রক্তে সূর্যের বিদায় আভায় কর্ণফুলী ও ভৈরব নদীর জলরাশি উদ্বেল হয়ে উঠলে পাকিস্তানী সমর পরিকল্পনাবিদের নিষ্ঠুর নির্দেশ বাস্তবায়ন ও বাঙালী সেনা অফিসারদের দোদুল্যমানতা ও সিদ্ধান্তহীনতা এ সব হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী। ২১শে মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ দীর্ঘ সময়। পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী বাঙালী সৈন্যদের উপর আক্রমণ করবে এ কথা জিয়াউর রহমান নিজ কানে শােনার পরও সশস্ত্র প্রতিরােধ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি অথবা আক্রমণের এই পূর্ব পরিকল্পনা আন্দোলনকারী জনশক্তিকে জানাননি।

এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহেই স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিদ্রোহী বাঙালী সশস্ত্র বাহিনীর অফিসার ও জোয়ানদের নিকট পরিষ্কার হয়ে আসে যে, পাকসামরিক বাহিনীকে প্রতিরােধ ও হটিয়ে দেবার জন্য পর্যাপ্ত সৈন্যবল, অস্ত্রশস্ত্র ও লজিষ্টিক সাপাের্ট তাদের নেই। পরিকল্পনাবিহীন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বাঙালি সশস্ত্রবাহিনী ক্রমশই ভারত সীমান্তের দিকে দ্রুত ভীড় জমাতে থাকে। সীমান্ত অঞ্চলের সর্বত্রই ঐ একই অবস্থা লক্ষ্যণীয় ও দৃষ্টিগােচর হতে থাকে।

৪ঠা এপ্রিল। বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত, ক্লান্ত ও নুয়ে পড়া সামরিক অধিনায়কগণ তেলিয়াপাড়ার হেড কোয়ার্টারে সমবেত হন। কর্ণেল ওসমানী, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মােশাররফ, লেঃ কর্ণেল সালাউদ্দিন মােঃ রাজা, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর নূরুল ইসলাম, মেজর মইনুল হােসেন চৌধুরী, লেঃ কর্ণেল আব্দুর রব কতিপয় বাঙালী সামরিক অধিনায়ক ঐদিন কর্ণেল ওসমানীকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বাঙালী সামরিক অফিসারদের পক্ষে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পকাশ্যতঃ কোনরূপ জটিলতা না থাকলেও ভেতরে ভেতরে কোন কোন অফিসারের মধ্যে এ বিষয়ে স্পষ্টতঃই দ্বিমত ছিল।

মেজর শফিউল্লাহ মনে করেছিলেন যেহেতু এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল তার দখলে এবং তার অধীনস্থ বাহিনী অত্যন্ত বীরত্বের সংগে পাক হানাদার বাহিনীর সংগে সংঘর্ষে প্রাথমিক সাফল্য অর্জন করেছে, সেজন্য স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব তার উপর অর্পিত হওয়া উচিত।

খালেদ মােশাররফও অত্যন্ত সাহসী, পরিকল্পিতভাবে প্রতিরােধ যুদ্ধ পরিচালনায় পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেছেন। সে জন্য যুদ্ধের প্রধানতম দায়িত্ব তার উপর অর্পিত না হলেও সামরিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার একটি বিশিষ্ট ভূমিকা থাকবে এটা তার মনে স্বাভাবিক আকাঙ্খ হিসেবেই কাজ করে থাকবে।

অন্যদিকে গােয়েন্দা কার্যক্রমে দক্ষ ও পটু জিয়াউর রহমানের উচ্চাভিলাষী ঘােষণায়। চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে ইতিপূর্বেই প্রচারিত হয়ে পড়েছিলাে। জিয়াউর রহমান কোনরূপ যুদ্ধ বা সশস্ত্র প্রতিরােধে অংশগ্রহণ না করে অত্যন্ত দ্রুততার সংগে বিপ্লবী সরকারের প্রধান বলে নিজেকে ঘােষণা করেন এবং প্রায় একই সময়ে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়করূপে নিজেকে উপস্থাপিত করেছিলেন।

তেলিয়াপাড়া সামরিক নেতৃবৃন্দের বৈঠকে উপস্থিত হয়ে জিয়াউর রহমান অতি সহজেই উপলব্ধি করেন যে, সামরিক বাহিনীর সেনাপতিরূপে তার বেতার ঘােষণা তার জন্য শুভ প্রতিক্রিয়া বয়ে আনেনি। জিয়াউর রহমান অত্যন্ত স্পষ্টভাবে দেখতে পেলেন তার পক্ষে সশস্ত্র বাহিনী পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ অথচ আকাঙ্খত পদটি দখল করা সম্ভব হবে না। কেননা ইতিমধ্যেই মেজর সফিউল্লাহ-খালেদ মােশাররফ সমঝােতামূলক ঐক্য সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।

মেজর সফিউল্লাহ ছিলেন খালেদ মােশাররফের কাছাকাছির লােক। পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে চাকুরীরত অবস্থায় জিয়াউর রহমানের বাঙালীদের প্রতি অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে তার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ সম্পর্কে অনিশ্চয়তায় রাজনীতি সচেতন খালেদ মােশাররফের নিকট স্বাধীনতা যুদ্ধে সশস্ত্র নেততুদানে জিয়াউর রহমান ছিলেন অগ্রহণযােগ্য। সফিউল্লাহ – খালেদের সমঝােতায় ক্ষুব্ধ জিয়াউর রহমানের নিকট ঐ অবস্থায় কর্ণেল ওসমানীকে যুদ্ধ পরিচালনায় সামরিক নেতৃত্ব প্রদানের বিষয়টিতে সম্মতি জ্ঞাপন ব্যতীত অন্য কোন পথ খােলা ছিলাে না। সফিউল্লাহর চেয়েও কর্ণেল ওসমানীই ছিলেন ঐ প্রেক্ষিতে সর্বাধিক গ্রহণযােগ্য ব্যক্তিত্ব। উপরে উপরে কর্ণেল ওসমানীর প্রতি আনুগত্য দেখালেও জিয়াউর রহমানের মনে সব সময়ই একথা জাগরূক ছিলাে উঠতি সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে তিনি সিনিয়র ও যােগ্য এবং যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব তারই প্রাপ্য। তরুণ মেজরদের চাপ ছিলাে প্রচন্ড সামরিক বাহিনীর এসব তরুণ মেজরগণ প্রায় প্রত্যেকেই যুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থায় সামরিক নেতৃত্ব গ্রহণের বিষয়টিকেই মৌলভাবে প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন। সামরিক প্রাধান্যের ঐক্য ফর্মুলায় শেষ পর্যন্ত কণল ওসমানীর নেতৃত্ব টেকনিক্যাল কারণে মেনে নিলেন। তাদের চাপে বলতে গেলে তাদের সন্তুষ্ট রাখার জন্য দুর্বল চিত্ত বাহ্যতঃ ‘পাপা টাইগার’ কর্ণেল ওসমানী তাদের নামে তিনটি বিগ্রেড গঠন করতে বাধ্য হন।

মেজর খালেদ মােশাররফের নামে কে ফোর্স, মেজর সফিউল্লাহর নামে এস ফোর্স এবং জিয়াউর রহমানের নামে জেড ফোর্স গঠন করতে হয়। কে ফোর্স, এস ফোর্স ও জেড ফোর্স এই মেজরদের আদ্যাক্ষর নিয়ে গঠিত বিগ্রেড। ব্যক্তি বিশেষের নামে গঠিত এসব বিগ্রেড গঠন যেমন ছিল অভিনব, তেমনি সামরিক বাহিনীর ইউনিফাইড কমান্ড পরিচালনায় তা ছিলাে প্রতিবন্ধক। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গঠিত এসব বিগ্রেড বাহিনী সামরিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে যা বাংলাদেশ বা সেনাবাহিনী কারাের জন্যই মঙ্গলজনক হয়নি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে পরবর্তীকালে ক্যু, কাউন্টার ক্যু এবং সেনাশূঙ্খলা বিরােধী কার্যক্রম সংঘটনে প্রমাণিত হয়েছে এসব বিগ্রেড গঠনের সিদ্ধান্ত ছিল মারাত্মক রকম ভুল সিদ্ধান্ত। তাছাড়া এই তিন অধিনায়কের কারােই ইতিপূর্বে বিগ্রেড পরিচালনার কোন অভিজ্ঞতা ছিলােনা। প্রধান সেনাপতি কর্ণেল ওসমানী অপারেশন প্ল্যান তৈরী করার মূল্যায়নে এইসব বিগ্রেড সম্পর্কে বলেছেন, “যে কাজের জন্য বিগ্রেড গঠন করা হয়েছিল, তা অর্জনের ক্ষেত্রে এ যাবত বিগ্রেডকে ব্যবহার করা যায়নি এবং অদূর ভবিষ্যতেও করা যাবে বলে মনে হয় না।”

বিরাজমান যুদ্ধ পরিস্থিতি, ওয়ার প্লান, টেকটিক্যাল এবং লজিস্টিক সাপাের্ট ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ-আলােচনার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ যুদ্ধ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও গ্রহণ অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছিলাে। ১৬শে মার্চে পর হতে যে স্বতঃস্ফূর্ত সশস্ত্র প্রতিরােধ যুদ্ধের জোয়ার শুরু হয়েছিলাে। বাস্তব অবস্থায় ৭ সপ্তাহের মধ্যেই তা ক্রমাগত শুকিয়ে আসছিলাে।

পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সমন্বিত তৎপরতা, আক্রমণ চালনার দক্ষতা এবং পরিচ্ছন্ন ও নির্ভূল টার্গেট অর্জনে লক্ষ্যবদ্ধতা অচিরেই বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকা থেকে বাঙালী সেনাবাহিনীকে সীমান্তের ওপারে প্রতিবেশী ভারতে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। এ কাজটি করতে তাদের সময় লেগেছিল মাত্র তিন সপ্তাহ। ভারতে তাড়িত বাঙালী সেনা সদস্যদের সংখ্যাল্পতা, বিপর্যস্ত মানসিকতা এবং অশেষ দৈহিক ক্লেশের চাপে হঠাৎ মনে হলাে বাংলাদেশের যুদ্ধ যেন থেমে গেছে! বাংলাদেশের ভেতরেও এমন একটা পরিস্থিতির উদ্ভব হতে থাকে যে, পাক বাহিনীর এ বিজয় যেন চিরস্থায়ী, বাঙালী সেনাবাহিনী, যুব-তরুণ এবং দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদদের দালাই লামার মতাে আমৃত্যু ভারতের মাটিতেই যেন থেকে যেতে হবে। অবস্থার এই নাজুকতায় বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডারগণ প্রধান সেনাপতি কর্ণেল ওসমানীর দক্ষতা এবং ক্ষমতার উপর প্রশ্নবােধক চিহ্ন অংকনে কুণ্ঠিত হননি।

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ও রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম কর্তৃক রণক্লান্ত সৈনিকদের মনােবল, ভবিষ্যৎ যুদ্ধ পরিকল্পনা এবং রণকৌশল সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনার উদ্যোগকে প্রধান সেনাপতি প্রসন্ন চিত্তে গ্রহণ করেননি, সেক্টর কমান্ডারদের বৈঠক আহ্বানকে তিনি তার ব্যক্তিগত সনের সংগে জড়িয়ে ফেলেন। সার্বিক অবস্থার প্রেক্ষিতে তিনি পদত্যাগপত্র পেশ করেন। এই বৈঠকের দিনগুলাের মধ্যেই কলকাতার পার্কস্ট্রীটে আনু মামার বাসায় কতিপয় সেক্টরের অধিনায়কগণ বেশ কয়েকটি বৈঠকে বসে তাদের সমন্বয়ে একটি যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের ও প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীকে দেশরক্ষামন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত করার প্রস্তাব বিবেচনা করেন। তরুণ অথচ এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী অধিনায়কদের সমন্বয়ে উক্ত যুদ্ধ কাউন্সিল হতে মুক্তিযুদ্ধের সমগ্র ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব তাদের উপর দেয়া হােক এই প্রস্তাব সরাসরি বৈঠকে উত্থাপিত হয়। যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের এই প্রস্তাবের পেছনে মূল ব্যক্তি ছিলেন জিয়াউর রহমান। সেক্টর কমান্ডার খালেদ মােশাররফ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এই প্রস্তাবের বিরােধীতা করলে সামরিক নেতৃত্বের দ্বিধাবিভক্তির পরিণামে ‘যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের’ প্রস্তাবটি তেমন ‘জোর’ পায়নি। ১১-১৭ জুলাই পর্যন্ত এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত কর্ণেল ওসমানী তার পদত্যাগ পত্র প্রত্যাহার করে নেন। কর্ণেল ওসমানী তার পদত্যাগ পত্র প্রত্যাহার করে দ্বিতীয় দিন হতে অধিবেশনে যােগদান করেন। এই বৈঠকেই যুদ্ধের খুঁটিনাটি দিক, সমস্যাসমূহ, ভবিষ্যৎ কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা হয়। এই বৈঠকে লেঃ কর্ণেল এম, এ, রবকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ, গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ, কে, খন্দকারকে ডেপুটি চীফ অব স্টাফ নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বৈঠকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল তার মধ্যেঃ ক. বিভিন্ন সেক্টরের সীমানা নির্ধারণ, খ. গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা, গ. নিয়মিত হিনীকে ব্যাটালিয়ন, ফোর্স ও সেক্টর টুপসের ভিত্তিতে সংগঠিত করা।

২৫শে মার্চের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরােধ যুদ্ধের প্রাথমিক সাফল্য ও উল্লাস অপসৃত হতে বেশী দিন লাগেনি। সীমান্তের ওপারে তাড়িত সেনাবাহিনীকে প্রথম দিকে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর কমান্ডারগণ গােলাবারুদ ও যুদ্ধ রসদ দিয়ে সাহায্য সহযােগিতা করলেও মে মাসের শেষ সপ্তাহ হতে জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাঙালী সেনাবাহিনীর প্রতি বি,এস, এফের উষ্ণতা হ্রাস পেতে থাকে। ভারতীয় সমর পরিকল্পনাবিদগণ ঐ সময় টোটাল ওয়ার প্ল্যান নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফলে দিল্লীর কোন সুস্পষ্ট নির্দেশ উহ্যই থেকে যায়, ফলে ভারত থেকে পর্যাপ্ত অস্ত্র পাবার আশা ভঙ্গ হয়ে পড়লে সামরিক অধিনায়কগণ অসহায় বােধ করতে থাকেন। প্রথম দিকে রাজনৈতিক নেতত্বকে তােয়াক্কা না করার যে উগ্র মানসিকতা এই সব ক্ষুদে মার্শালদের মধ্যে গড়ে উঠেছিলাে বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে তাদের এই সুপ্ত আকাক্ষা শীতল হতে থাকে। রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অধীনে তাদের যুদ্ধ পরিচালনা করা ব্যতীত অন্য কোন বিকল্প ছিলােনা।

জাতীয়, আন্তর্জাতিক এবং বাস্তব অবস্থার কারণে অনন্যোপায় হয়ে ২৬শে মার্চের স্বাধীনতা ঘােষণার ১১৪ দিনের মাথায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অধিনায়কগণ আনুষ্ঠানিকভাবে ১৭ই জুলাই বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে শপথ গ্রহণ করেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে জিয়া যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। একদিকে মানসিকভাবে যুদ্ধ করার পূর্ব প্রস্তুতি যেমন তার ছিলাে না-তেমনি অস্ত্রশস্ত্র ছিলাে না। ১৫০টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল, ১০৬ এম আর আর এবং দুটি ৩ ইঞ্চি মর্টার ছিলাে। এ সবের কোন গুলি পর্যন্ত ছিলাে না। ৮ম বেঙ্গর রেজিমেন্টের সমস্ত অস্ত্র গােলাবারুদ সব পশ্চিম পাকিস্তানে পূর্বেই পাঠানাে হয়েছিলাে। সেজন্য যারা বলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা ঘােষণা করেন এবং ঐ ঘােষণা পাঠের পূর্ব হতেই জিয়াউর রহমান যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন- একথা তথ্য সমৃদ্ধ নয় – এটি প্রচারণা ও বানােয়াট। যুদ্ধকালীন সময়েও জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণের কোন গৌরবজনক ও বীরত্বপূর্ণ ঘটনা খুঁজে পাওয়া যায় না।

সূত্রঃ জেনারেল জিয়ার রাজত্ব – অধ্যাপক আবু সাইয়িদ

মন্তব্যসমূহ
বই পড়তে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি' এ্যাপটি ব্যবহার করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button